ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের টনক নড়বে কি

সম্পাদকীয়

আমাদের সমাজে বেশির ভাগ মানুষ অন্যায়, অব্যবস্থা ও অনিয়ম মুখ বুজে মেনে নেয়। ভাবে, যেভাবে চলছে চলুক। কিন্তু এ ধারণার বিপরীতেও কেউ কেউ এগিয়ে আসে নিজের সুবিধার জন্য যতটা না, তার চেয়ে বেশি সমষ্টির কল্যাণের কথা ভেবে।

গত ৩০ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবুল হাসনাত আবদুল্লাহর একক প্রতিবাদকে আমরা কীভাবে নেব? তিনি এর মধ্য দিয়ে কেবল নিজের সমস্যার কথা বলেননি; বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক প্রশাসনিক অব্যবস্থা ও অনিয়ম তুলে ধরেছেন।

তঁার উত্থাপিত আট দফায় সেবা পেতে শিক্ষার্থীদের হয়রানি বন্ধ, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাজের জবাবদিহি আদায়ে অভিযোগ সেল গঠন, সব প্রশাসনিক কার্যক্রম ডিজিটালাইজড করা, অফিসের প্রতিটি কক্ষে সিসিটিভি ক্যামেরা বসানো, অফিস চলাকালে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ব্যক্তিগত, ব্যবসায়িক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকার কথা বলা আছে। একই সঙ্গে তিনি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সাচিবিক বিদ্যায় পারদর্শী হওয়া ও প্রশাসনিক কাজে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করার কথাও বলেছেন।

আবদুল্লাহর এসব দাবির সঙ্গে দ্বিমত প্রকাশের সুযোগ নেই। বিশ্ববিদ্যালয় তো বটেই, যেকোনো প্রতিষ্ঠানের প্রশাসনিক কাজ সুচারুভাবে সম্পন্ন করতে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জবাবদিহি অপরিহার্য। এ সমস্যার শিকড় খুঁজতে গিয়ে অনেক অজানা তথ্য বেরিয়ে এসেছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ লোকবল কম থাকার অজুহাত দিয়ে থাকে। কিন্তু লোকবলের ঘাটতিই বড় সমস্যা নয়। বড় সমস্যা হলো যোগ্যতা ও দক্ষতার ভিত্তিতে নিয়োগ না হওয়া। রাজনৈতিক প্রভাবে যাঁরা নিয়োগ পান, তাঁরা বরাবরই ধরাকে সরা জ্ঞান করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি তাঁদের দায়বদ্ধতা নেই। তাঁরা দায়বদ্ধ থাকেন তাঁদের প্রতি, যাঁদের আনুকূল্যে বা সুপারিশে নিয়োগ পেয়ে থাকেন।

প্রশাসনিক সেবা পেতে সব শিক্ষার্থীই কমবেশি ভোগান্তির শিকার হন। আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পরই ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার কথা বলে আসছে। কিন্তু দেশের প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কাজও চলছে সেকেলে পদ্ধতিতে। ফলে শিক্ষার্থীদের সেবা পেতে দিনের পর দিন প্রশাসনিক ভবনে ঘুরতে হয়। এতে যে তাঁদের পড়াশোনায় ব্যাঘাত ঘটছে, অনেক কর্মকর্তা কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তা-ও অনুধাবন করতে অপারগ। প্রশাসনিক অব্যবস্থার বিরুদ্ধে এক শিক্ষার্থী প্রকাশ্যে প্ল্যাকার্ড নিয়ে প্রতিবাদ করেছেন। এরপরও যদি কর্তৃপক্ষের টনক না নড়ে, তাহলে বুঝতে হবে, সেখানকার পদাধিকারীরা কালা ও অন্ধ।

আবুল হাসনাত আবদুল্লাহর ভাষ্য অনুযায়ী, স্মারকলিপি পেশকালে উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামান তাঁর দাবিগুলোর যৌক্তিকতা স্বীকার করে নিয়ে বাস্তবায়ন করা ও ক্রমান্বয়ে দাপ্তরিক কাজগুলোর আধুনিকায়ন করার আশ্বাস দিয়েছেন। ইতিমধ্যে কয়েকটি দপ্তরের আধুনিকায়ন করা হয়েছে বলেও জানিয়েছেন তিনি। এটি যে নিছক কথার কথা নয়, সেটি তাঁকে কাজের মাধ্যমেই প্রমাণ করতে হবে।

যে বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের গৌরব হিসেবে চিহ্নিত, যে বিশ্ববিদ্যালয় শতবর্ষ পূরণ করেছে, সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা প্রশাসনিক সেবা পেতে এভাবে হয়রানি ও ভোগান্তির শিকার হবেন, তা কোনোভাবে মেনে নেওয়া যায় না।

বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন উপাচার্য, দুজন সহ-উপাচার্য ও একজন রেজিস্ট্রার আছেন, তারপরও কেন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জবাবদিহির আওতায় আনা যাবে না? বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশাসনিক সেবার মান নিশ্চিত করতে হলে যোগ্যতা ও দক্ষতার ভিত্তিতে সব নিয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।

আবার নিয়োগ পাওয়ার পরও যাতে চাকরিকে ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ ভাবতে না পারেন, সে জন্য জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। রাজনৈতিক বিবেচনায় সব ধরনের নিয়োগ বন্ধ করতে হবে।