সাধ ও সাধ্যের সমন্বয় হবে কবে

সম্পাদকীয়

তীব্র তাপপ্রবাহের কারণে বিদ্যুতের চাহিদা বেড়েছে এবং সরকার সাধ্যানুযায়ী উৎপাদন বাড়ানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু সাধ ও সাধ্যের সমন্বয় ঘটছে না কোনোভাবেই।

বিদ্যুৎ উৎপাদনে নতুন রেকর্ড গড়লেও ঘাটতি এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। বিদ্যুৎ বিভাগ, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি), পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশের (পিজিসিবি) ন্যাশনাল লোড ডেসপ্যাচ সেন্টারের (এনএলডিসি) তথ্য অনুযায়ী, গত সোমবার দিনের বেলায় তিন হাজার মেগাওয়াটের বেশি লোডশেডিং করতে হয়েছে।

দেশে এখন বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা প্রায় ২৬ হাজার মেগাওয়াট। উৎপাদিত হচ্ছে ১৩ থেকে সাড়ে ১৫ হাজার মেগাওয়াট পর্যন্ত। জ্বালানিবিশেষজ্ঞ এম শামসুল আলম বলেছেন, প্রকৃত লোডশেডিংয়ের পরিমাণ আরও অনেক বেশি। গ্রাহকের কাছে বিদ্যুৎ পৌঁছানো বিতরণ সংস্থার হিসাবেও বাড়তি লোডশেডিংয়ের তথ্য পাওয়া গেছে।

সোমবার সবচেয়ে বড় বিতরণ সংস্থা পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি) একাই লোডশেডিং করেছে ৩ হাজার ৪৮৩ মেগাওয়াট। তাদের চাহিদা ৯ হাজার ৪৮০ মেগাওয়াটের বিপরীতে সরবরাহ করা হয়েছে ৫ হাজার ৯৯৭ মেগাওয়াট। এর অর্থ, ৩৭ শতাংশ ঘাটতি নিয়েই আরইবির এলাকা চলছে। কোথাও কোথাও তিন থেকে পাঁচ ঘণ্টা পর্যন্ত লোডশেডিং চলে। প্রথম আলোর খবর অনুযায়ী, ময়মনসিংহে লোডশেডিংয়ের মাত্রা সবচেয়ে বেশি। এরপরই চট্টগ্রাম, রংপুর, কুমিল্লা, রাজশাহী, সিলেট ও বরিশাল অঞ্চল ও ঢাকার আশপাশের জেলাগুলোয় লোডশেডিং করতে হচ্ছে।

পিডিবির সদস্য (উৎপাদন) খন্দকার মোকাম্মেল হোসেনও স্বীকার করেছেন, জ্বালানি তেলচালিত কেন্দ্র থেকে লক্ষ্যমাত্রা অনুসারে উৎপাদন করা যাচ্ছে না। সে ক্ষেত্রে সরকারকে জ্বালানি তেলের সরবরাহ বাড়াতে হবে।

বিদ্যুতের ঘাটতির কারণে সংশ্লিষ্ট এলাকার জনজীবনই বিপর্যস্ত হচ্ছে না, শিল্প ও কৃষি উৎপাদনও মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। একসময় কৃষি ও শিল্পে বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে বসতবাড়ি ও মার্কেটে লোডশেডিং করা হতো। এখন কোনোটাই ভালোভাবে সামাল দেওয়া যাচ্ছে না। বর্ধিত চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের উচিত ছিল জ্বালানিতে কীভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়া যাবে, সেদিকে নজর দেওয়া। কিন্তু সেটি না করে তারা একদিকে বিদ্যুৎকেন্দ্র বাড়িয়ে চলেছে, অন্যদিকে জ্বালানি খাতকে আমদানিনির্ভর করে ফেলেছে।

সরকার ২৬ হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রতিষ্ঠার কৃতিত্ব দাবি করছে; কিন্তু সেগুলো চালানোর জন্য প্রয়োজনীয় গ্যাস ও জ্বালানি যদি সরবরাহ করতে না পারে, তাহলে সক্ষমতা বাড়িয়ে কী লাভ হলো? সরকার সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের যে লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছিল, সেটাও অর্জিত হলো না। শত ভাগ ঘরে বিদ্যুৎ দিতে হলে সৌরবিদ্যুতের জোগানও বাড়াতে হবে।

বর্তমান যুগে বিদ্যুৎ ছাড়া এক মুহূর্ত চলা যায় না। বিদ্যুৎ না থাকলে কী রকম ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়, গত বছর তা দেশবাসী টের পেয়েছে। বিদেশ থেকে চাহিদা অনুযায়ী জ্বালানি আমদানি করা যাচ্ছে না ডলার–সংকটের কারণে, কিন্তু সরকার দেশীয় গ্যাস ও তেলসম্পদ অনুসন্ধান ও আহরণের চেষ্টা বাড়াল না কেন?

দু-এক দিনের মধ্যে বৃষ্টির দেখা মিলতে পারে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া দপ্তর। এর অর্থ এই নয় যে তাপপ্রবাহ থেকে আমরা শিগগিরই মুক্তি পাচ্ছি। মে মাসও গরমের তীব্রতা বেশি থাকে। সরকার আশা করছে, চলতি বছরের শেষ নাগাদ রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম ইউনিটের উৎপাদন শুরু হবে। সেই সময় পর্যন্ত ডলার–সংকটের দোহাই দিয়ে হাত গুটিয়ে বসে থাকলে হবে না। শিল্পকারখানা, ব্যবসা-বাণিজ্য ও কৃষি উৎপাদন অব্যাহত রাখতে হলে বিদ্যুৎ সরবরাহ বাড়াতেই হবে।

লোডশেডিং করে দেশের অর্থনীতি এগিয়ে নেওয়া যাবে না।