শর্ষের ভেতরের ভূত তাড়াবে কে

সম্পাদকীয়

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য ও মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা–কর্মচারীদের দায়িত্ব মাদক ব্যবসা ও সেবন বন্ধ করা। কিন্তু সেই রক্ষকেরাই যদি ভক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন, তাহলে মাদকের ভয়াবহ থাবা থেকে দেশ মুক্ত হতে পারে না। 

প্রথম আলোর খবর জানাচ্ছে, ইয়াবা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ছাত্রীকে ফাঁসাতে গিয়ে নিজেই ফাঁসছেন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা। ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা করার অভিযোগে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের উপপরিদর্শক (এসআই) শেখ মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেনের বিরুদ্ধে মামলার নির্দেশ দিয়েছেন ঢাকার একটি আদালত। 

উল্লেখ্য, গত বছরের ১৬ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর খিলক্ষেতে ওই ছাত্রীর বাসায় অভিযান চালিয়ে তাঁর কাছ থেকে এক হাজার ইয়াবা উদ্ধার দেখানো হয়। এ ঘটনায় ওই ছাত্রীর বিরুদ্ধে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা হলে তাঁকে চার মাস জেল খাটতে হয়। জামিনে বের হওয়ার পর ওই ছাত্রী এসআই সাজ্জাদের বিরুদ্ধে জালিয়াতির মামলা করলে তদন্তে উঠে আসে, সেদিন তাঁর কাছ থেকে মাদক উদ্ধার করা হয়নি। যে নারী এসআইয়ের মাধ্যমে ওই ছাত্রীর দেহ তল্লাশি করা হয়েছিল, সেই এসআই রোকেয়া আক্তার লিখিতভাবে জানান, ওই দিন তিনি অভিযানে যাননি। ওই ছাত্রীকেও তিনি চেনেন না।

যে পুলিশ কর্মকর্তা মাদক উদ্ধারের নামে একটি জলজ্যান্ত মিথ্যা মামলায় বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীকে ফাঁসাতে পারেন, তিনি সাধারণ মানুষের ওপর কী ধরনের নির্যাতন চালাতে পারেন, সেটা সহজেই অনুমান করা যায়। সাজ্জাদ হোসেনের অপকর্ম এখানেই শেষ নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ছাত্রীর মামলা তদন্তাধীন থাকা অবস্থায় তাঁর বিরুদ্ধে ২০ হাজার টাকা ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। 

এই ধরনের ব্যক্তিদের দিয়ে আর যা–ই হোক মাদকবিরোধী অভিযান সফল হওয়ার সম্ভাবনা নেই। মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সূত্র অনুযায়ী, নানা অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগে তদন্ত শেষে ২০২২ সালে ৩৮ কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করেছে সংস্থাটি। এর মধ্যে নিষ্পত্তি হয়েছে ৩০টি মামলার। শুধু ১৯ জনের বিরুদ্ধে নামকাওয়াস্তে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। তাতে শাস্তি হিসেবে কারও ইনক্রিমেন্ট স্থগিত হয়, কাউকে করা হয় তিরস্কার। বাকি ১১ জন অব্যাহতি পান।

মামলার সংখ্যা দিয়ে বোঝা যাবে না আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কত সদস্য কিংবা মাদক অধিদপ্তরের কতজন কর্মকর্তা এসব অপকর্মের সঙ্গে জড়িত। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ছাত্রী জামিনে বেরিয়ে আসার পর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা করেছেন বলেই সাজ্জাদ হোসেনের অপকর্ম বেরিয়ে এসেছে। বেশির ভাগ ভুক্তভোগী হয়রানির ভয়ে ঝামেলায় জড়াতে চান না। 

কয় দিন আগে রাজবাড়ীতে একজন পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কলেজছাত্রকে ইয়াবা দিয়ে ফাঁসানোর চেষ্টা এবং মারধর করার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ ঘটনায় ওই শিক্ষার্থী ভিডিও প্রমাণ সংযুক্ত করে পুলিশ সুপারের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। তল্লাশির নামে মাদকদ্রব্য দিয়ে সাধারণ মানুষকে ফাঁসানোর অভিযোগ পুলিশের বিরুদ্ধে নতুন নয়।

এসব ঘটনা প্রমাণ করে, সরকারের যেসব কর্তৃপক্ষ মাদক নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে নিয়োজিত, হয় তারা মাদকের ভয়াবহতা অনুধাবন করতে পারছে না, অন্যথায় তারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যেসব সদস্য মাদকসংক্রান্ত অপকর্মের সঙ্গে যুক্ত, তাঁদের বিষয়ে ‘দাতা হাতেম তাই’ মনোভাব দেখাতে পারতেন না। শর্ষের ভেতরে ভূত থাকলে মাদক নির্মূল যেমন কখনো সম্ভব হবে না, তেমনি নিরীহ মানুষের হয়রানিও কমবে না। এখানে শুধু হয়রানিই ঘটছে না, ভুক্তভোগী মানুষ সামাজিকভাবে সম্মানহানির শিকারও হচ্ছেন। মাদক সেবন বা বেচাকেনার সঙ্গে যুক্ত না থেকেও অপরাধী হিসেবে অপবাদ জুটছে তাঁদের। এমন একটি ঘটনায় একজন ব্যক্তি বা একটি পরিবারের মধ্যে মানসিকভাবে বিপর্যয় নেমে আসে। 

মাদকসংক্রান্ত প্রতিটি মামলার দ্রুত সুষ্ঠু ও বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত এবং দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি নিশ্চিত করা হোক। বন্ধ হোক তল্লাশির নামে নিরীহ ও নিরপরাধ মানুষকে হয়রানি।