আর্থিক, রাজনৈতিক ও পারিবারিক উদ্বেগের কারণে ভবিষ্যৎ নিয়ে দেশের ৪৬ শতাংশ মানুষের আশা হারানো যারপরনাই উদ্বেগের। একটা সমাজের প্রায় অর্ধেক জনগোষ্ঠী যদি জিনিসপত্রের দাম, চিকিৎসা, দুর্নীতি, সন্তানের পড়াশোনা, মাদক, কিশোর অপরাধ—এসব নিয়ে উদ্বেগের কারণে ভবিষ্যৎ নিয়ে আশাহীন হয়ে পড়েন, তাহলে সেই সমাজের স্বাভাবিক বিকাশ কীভাবে সম্ভব?
গত কয়েক দশকে আমাদের সমাজ, রাজনীতি ও অর্থনীতিতে যে গোষ্ঠীতন্ত্র গেড়ে বসেছে, তাতে উন্নয়নের সুফল মুষ্টিমেয় সুবিধাভোগীর হাতেই যে কেন্দ্রীভূত হয়েছে, এ চিত্র তারই নির্মম প্রতিফলন। সুনির্দিষ্ট নীতিকৌশল ও তার ন্যায়নিষ্ঠ প্রয়োগ ছাড়া চুইয়ে পড়া রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থার অসাড়তারও প্রমাণ এটি।
বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) জরিপে এই তথ্যের পাশাপাশি আর যেসব তথ্য উঠে এসেছে, সেটা আমাদের নীতিনির্ধারক ও রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য সতর্কবার্তা বলেই মনে করি। কেননা, দলগুলো মুখে গণতন্ত্র ও জনগণের কথা বললেও শেষ পর্যন্ত ব্যবসায়ী, আমলাতন্ত্র ও ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক গোষ্ঠীর স্বার্থকেই সিদ্ধি করে। এই ধারা থেকে সরে এসে নাগরিকদের স্বার্থে নীতি প্রণয়ন ও কর্মসূচি দেওয়া আশু কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বাংলাদেশ কেন সামাজিক অসন্তোষ, অসহিষ্ণুতার মতো ঘটনার একটি উর্বর ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে, তার কিছু নমুনা পিপিআরসির জরিপ থেকে আঁচ করা সম্ভব। গত মে মাসে দেশের ৮ হাজার ৬৭টি খানার মধ্যে এই জরিপ পরিচালনা করা হয়। ২৩ সেপ্টেম্বর রাতে ভার্চ্যুয়াল মাধ্যমে অনুষ্ঠিত ‘পরিবার পর্যায়ে মনস্তাত্ত্বিক অবস্থান’ শীর্ষক এক আলোচনায় সংস্থাটির সাম্প্রতিক জরিপের ফলাফল তুলে ধরা হয়।
জরিপে উঠে এসেছে, প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষ দ্রব্যমূল্য নিয়ে উদ্বিগ্ন। সন্তানের শিক্ষা নিয়ে উদ্বিগ্ন ৬৫ শতাংশ মানুষ। কিশোর অপরাধ ও মাদক নিয়ে উদ্বিগ্ন যথাক্রমে ৫৫ ও ৫৬ শতাংশ মানুষ। জরিপের পারিবারিক মনস্তত্ত্ব অংশের ফলাফল তুলে ধরে বলা হয়, প্রায় ২০ শতাংশ মানুষ আর্থিক সংকটের মধ্যে আছেন। তাঁদের মধ্যে ৬৭ শতাংশ চিকিৎসা ব্যয় এবং ২৭ শতাংশ ঋণ পরিশোধ নিয়ে সংকটে আছেন।
সরকারি সেবা পেতে নাগরিকেরা কী ধরনের হয়রানির শিকার হন, তারও একটা ধারণা পাওয়া যায় জরিপ থেকে। সূচক হিসেবে হয়রানি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কেননা অনেক ক্ষেত্রে এর অবস্থান দুর্নীতিরও ওপরে।
চব্বিশের গণ–অভ্যুত্থান বাংলাদেশের সামনে পরিবর্তনের বিশাল একটা সুযোগ নিয়ে এসেছে। কিন্তু সংস্কার নিয়ে সরকারের যে উদ্যোগ, তাতে সাধারণ নাগরিকেরা যেমন বাদ পড়ে গেছেন, আবার তাঁরা আগ্রহও হারিয়েছেন।
জরিপে অংশ নেওয়া ৭৪ শতাংশই জানিয়েছেন, টাকা না দিলে সরকারি সেবা পাওয়া যায় না। আর ৭১ শতাংশ মানুষ জানিয়েছেন, সরকারি সেবা নিতে গিয়ে তাঁরা হয়রানির শিকার হয়েছেন। সরকারি সেবা নাগরিকের কাছে যে কতটা দুষ্প্রাপ্য এবং আমাদের সরকারি চাকরিজীবীদের মানসিকতা এখনো কতটা ঔপনিবেশিক, এই ফলাফল তারই চাক্ষুষ দৃষ্টান্ত।
বিদ্যমান বাস্তবতা থেকে উত্তরণে নাগরিকের চাওয়ার জায়গাগুলো পূরণে উদ্যোগ নেওয়া অত্যন্ত জরুরি বলে আমরা মনে করি। জরিপে উঠে এসেছে, ৫৩ শতাংশ মানুষ সামাজিক সম্মান চান। অর্থনৈতিক ও স্বাস্থ্যসেবার উন্নতি চান তাঁরা। রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষার বিষয়ে ৫৬ শতাংশ মানুষ দুর্নীতি প্রতিরোধের কথা বলেছেন। চব্বিশের গণ–অভ্যুত্থান বাংলাদেশের সামনে পরিবর্তনের বিশাল একটা সুযোগ নিয়ে এসেছে। কিন্তু সংস্কার নিয়ে সরকারের যে উদ্যোগ, তাতে সাধারণ নাগরিকেরা যেমন বাদ পড়ে গেছেন, আবার তাঁরা আগ্রহও হারিয়েছেন।
আমরা মনে করি, এই পরিস্থিতি সৃষ্টির পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ হলো মানুষ দৈনন্দিন জীবনে যেসব সংকটের মুখে পড়ে, তারই সমাধান চান। জিনিসপত্রের দাম, চিকিৎসা নিতে গিয়ে সীমাহীন ব্যয়, সন্তানের পড়াশোনায় মাত্রাতিরিক্ত খরচ, সরকারি সেবা নিতে গিয়ে ঘুষ ও হয়রানি, মাদক, কিশোর অপরাধ—এসব সমস্যা আমাদের পরিবারগুলোকে প্রতিনিয়ত মোকাবিলা করতে হয়। ফলে এসব সংকটের সমাধান ছাড়া আর কোনো সংস্কার উদ্যোগ টেকসই হতে পারে না।
সংস্কার চিন্তায় রাজনৈতিক গোষ্ঠী নয়, নাগরিকদের সংকটকে গুরুত্ব দিতে হবে।