সুষ্ঠু তদন্ত ও রহস্য উন্মোচিত হোক

সম্পাদকীয়

ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীমের ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের রাজধানী কলকাতায় খুন হওয়ার ঘটনাটি অত্যন্ত মর্মান্তিক ও উদ্বেগজনক। বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশের একজন আইনপ্রণেতার খুনের ঘটনা এই প্রথম। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের ভাষ্য অনুযায়ী, আনোয়ারুল আজীমের খুনের ঘটনাটি পরিকল্পিত এবং খুনের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা বাংলাদেশের নাগরিক।

আনোয়ারুল আজীমের খুনের বিষয়ে যেসব চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে, তা ক্রাইম থ্রিলারের কাহিনিকেও হার মানায়। গোয়েন্দা বিভাগের সূত্র অনুযায়ী, আখতারুজ্জামান নামের একজন যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী এক মাস আগে এই হত্যার পরিকল্পনা করেন, যিনি আনোয়ারুল আজীমের বন্ধু ও ব্যবসায়িক অংশীদার। ব্যবসার ভাগ-বাঁটোয়ারা নিয়ে বিরোধের জের ধরে এ হত্যাকাণ্ড ঘটেছে।

১২ মে আনোয়ারুল আজীম চিকিৎসার জন্য সড়কপথে কলকাতা যান এবং এক বন্ধুর বাসায় ওঠেন। ১৩ মে তিনি চিকিৎসার কথা বলে ওই বাসা থেকে বের হয়ে আর ফিরে আসেননি। তাঁর ফোনটিও বন্ধ ছিল। ঢাকার ডিবি পুলিশ হত্যার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে তিনজনকে গ্রেপ্তার করে, যাঁরা হত্যাকাণ্ড শেষে ঢাকায় ফেরেন। হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী আখতারুজ্জামান পালিয়ে গেছেন বলে জানা গেছে।

গোয়েন্দা সূত্রগুলো বলছে, আখতারুজ্জামান কলকাতার নিউ টাউনের সঞ্জিভা গার্ডেনসের একটি ফ্ল্যাট ভাড়া করেন এবং সেখানে কৌশলে আনোয়ারুল আজীমকে নিয়ে ভাড়াটে লোক দিয়ে হত্যা করেন।

আনোয়ারুল আজীমের রাজনৈতিক ঠিকুজি খুঁজতে গেলে দেখা যায়, ১৯৮৮ সালে এক বিএনপি নেতার মাধ্যমে রাজনীতিতে আসেন তিনি। ১৯৯২ সালে কালীগঞ্জ পৌরসভার কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। পরে বিএনপি থেকে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে কালীগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হন। তাঁর বিরুদ্ধে ২১টি মামলা ছিল। ২০০৭ সালে ইন্টারপোল রেড নোটিশ জারি করেছিল। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর তাঁর বিরুদ্ধে আনীত সব মামলা প্রত্যাহার করা হয় এবং ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।

আনোয়ারুল আজীমের বিরুদ্ধে যেসব মামলা ছিল, তার সব কটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলার সুযোগ নেই। একজন আইনপ্রণেতার বিরুদ্ধে স্বর্ণ চোরাচালান ও হুন্ডি ব্যবসার যে অভিযোগ এসেছে, সেটা অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। আমরা আনোয়ারুল আজীম হত্যার সুষ্ঠু তদন্ত ও অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই। সেই সঙ্গে তিনি কী কারণে খুন হলেন, সে রহস্যও ভেদ করা জরুরি।

আনোয়ারুল আজীমের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাগুলো কি যথাযথভাবে তদন্ত হয়েছিল? যে ব্যক্তির বিরুদ্ধে ইন্টারপোল রেড অ্যালার্ট জারি করেছিল, তাঁকে আইনের মুখোমুখি না করা আইনের শাসনের লক্ষণ নয়। তিনি বিএনপি থেকে ক্ষমতাসীন দলে যোগ না দিলে এসব মামলা প্রত্যাহার হয়ে যেত? বাস্তবতা হলো রাজনৈতিক বিবেচনায় মামলা প্রত্যাহার ও শাস্তি মওকুফের বহু নজির আছে।

সরকারের নীতিনির্ধারকেরা চরমপন্থী নির্মূল করার দাবি করেছিলেন। তাঁদের দাবি যে সর্বাংশে সত্য নয়, আনোয়ারুল আজীমের হত্যার ঘটনা সেটাই প্রমাণ করে। হত্যার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে যাঁদের আটক করা হয়েছে, তাঁদের মধ্যে চরমপন্থী দলের সাবেক নেতা শিমুল ভূঁইয়া রয়েছেন, যিনি নিজেকে সৈয়দ আমানুল্লাহ বলে পরিচয় দিয়েছেন। এই নামে তিনি পাসপোর্ট বানিয়েছেন এবং একই নামে জাতীয় পরিচয়পত্রও তৈরি করেছেন।

আনোয়ারুল আজীম হত্যার ঘটনা কেবল ক্ষমতাসীন দল নয়, দেশকেও অনেকগুলো প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। খুনিরা নাম বদলিয়ে ভুয়া তথ্য ব্যবহার করে পাসপোর্ট ও জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি করে নির্বিঘ্নে দেশের বাইরে গেছেন এবং হত্যামিশন শেষ করে দেশেও ফিরে এসেছেন। তাহলে রাষ্ট্র ও জনগণের নিরাপত্তা কোথায়? ক্ষমতার রাজনীতির সঙ্গে ভয়াবহ অপরাধপ্রবণতার যুক্ততার যে অভিযোগ আছে, এ ঘটনার মধ্য দিয়ে সেটাই নতুন করে উন্মোচিত হলো।