বিশ্ব এখন ডিজিটাল রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ব্যবসা-বাণিজ্য, যোগাযোগ, শিক্ষাসহ জীবনযাপনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ডিজিটাল অভ্যস্ততা এখন বাস্তবতা। এই রূপান্তরের পথে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন সমস্যা, সংকট ও চ্যালেঞ্জ আসছে। ফলে প্রচলিত আইনের বদলে ডিজিটাল ব্যবস্থার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ আইন-বিধি প্রণয়নের প্রয়োজন পড়ছে। ডিজিটাল বিশ্বে সবচেয়ে মূল্যবান ও সংবেদনশীল সম্পদ হচ্ছে উপাত্ত। ফলে ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক উপাত্ত কার কাছে থাকছে, কীভাবে তা ব্যবহৃত হচ্ছে, রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ বা বহুজাতিক সংস্থা তাতে হস্তক্ষেপ কিংবা অপব্যবহার করছে কি না, এসব বিষয়ে উদ্বেগ ও মতবিরোধ তৈরি হচ্ছে।

সম্প্রতি সরকার উপাত্ত সুরক্ষা আইন-২০২২-এর খসড়া প্রণয়ন করেছে, এ বছরের শেষ নাগাদ সেটি জাতীয় সংসদে তোলার প্রস্তুতি চলছে। এ নিয়ে নানামুখী উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। আইনের সর্বশেষ খসড়ায় সংবেদনশীল উপাত্ত, ব্যবহারকারীর সৃষ্ট উপাত্ত ও শ্রেণিবদ্ধকরণ উপাত্ত বাংলাদেশে সংরক্ষণের কথা বলা হয়েছে।

উপাত্তবিশেষজ্ঞ, আইনের শিক্ষক, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কথা বলে প্রথম আলো মোটাদাগে উদ্বেগের দুটি কারণ পেয়েছে। প্রথমত, যেসব দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা শক্তিশালী নয়, সেসব দেশে সংরক্ষণ করা উপাত্ত ব্যবহার করে ভিন্নমত দমন করা হতে পারে। দ্বিতীয়ত, দেশেই উপাত্ত সংরক্ষণের কঠোর বাধ্যবাধকতায় ব্যবসা বাধাগ্রস্ত হতে পারে এবং ব্যয় বাড়তে পারে।

বিশেষজ্ঞদের প্রশ্ন হচ্ছে, দেশে যে ডেটা সেন্টারে উপাত্ত রাখা হবে, তার নিয়ন্ত্রণ কার হাতে থাকবে? সংরক্ষিত উপাত্তে যদি কর্তৃপক্ষের প্রবেশাধিকার থাকে, তাহলে তথ্যপ্রযুক্তির বড় বড় কোম্পানি গ্রাহকদের গোপনীয়তা ভাঙতে হবে বলে বাংলাদেশে সেবা দিতে না-ও চাইতে পারে। বাংলাদেশের ব্যবসায়ী সম্প্রদায় মনে করেন, এ ধরনের আইন হলে ব্যবসায় নেতিবাচক প্রভাব পড়বে ও বৈশ্বিক বাণিজ্যে বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়বে। রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্টের এক প্রতিবেদনে জানা যাচ্ছে, উপাত্তপ্রবাহে বিধিনিষেধ এলে বাংলাদেশ থেকে ডিজিটাল সেবা রপ্তানি ২৯-৪৪ শতাংশ পর্যন্ত কমে যেতে পারে।

তথ্যপ্রযুক্তিবিশেষজ্ঞরা মনে করেন, রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ও অত্যন্ত সংবেদনশীল তথ্য দেশে সংরক্ষণ করা উচিত। কিন্তু আইসিটি প্রতিমন্ত্রীর বক্তব্য থেকে এটা স্পষ্ট যে এ ক্ষেত্রে সক্ষমতার বড় ঘাটতি রয়েছে। তিনি জানান, বাংলাদেশে ক্লাউড বা ডেটা সেন্টার অবকাঠামো ও সক্ষমতা তৈরিতে যদি দুই বা তিন বছর সময় লাগে, সেটা দেওয়া হবে। অবস্থাদৃষ্টে ঘোড়ার আগেই গাড়ি জুড়ে দেওয়ার দৃষ্টান্ত এটি। শুধু অবকাঠামো বা ডেটা সেন্টার নির্মাণ নয়, সেগুলো পরিচালনার জন্য দক্ষ লোকবল রয়েছে কি না, তা নিয়েও উদ্বেগ রয়েছে। এ ক্ষেত্রে নিরাপত্তার প্রশ্নটি উপেক্ষা করার সুযোগ নেই।

ব্যক্তিগত তথ্যের সুরক্ষা গোপনীয়তার অধিকারের অংশ এবং গোপনীয়তার এ অধিকার বাংলাদেশের সংবিধানস্বীকৃত। কিন্তু আইনের খসড়ায় বলা হয়েছে, উপাত্ত সুরক্ষা আইনের অধীনে একটি কর্তৃপক্ষ গঠিত হবে এবং সরকার রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা, জনশৃঙ্খলাসহ নানা প্রয়োজনে সময়ে সময়ে উপাত্ত সুরক্ষা মহাপরিচালককে যেকোনো নির্দেশ প্রদান করতে পারবে।

এ ধরনের বিধান নাগরিকের ব্যক্তিগত তথ্যে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপের সুযোগ তৈরি করে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, গণমাধ্যমকর্মী আইন, প্রেস কাউন্সিল (সংশোধন) অ্যাক্ট, টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) একটি প্রবিধানমালা এবং তথ্য মন্ত্রণালয়ের ওটিটি (ওভার দ্য টপ) নীতিমালা, এ ধরনের নিবর্তনমূলক আইন ও বিধিবিধানের কারণে দেশে বাক্‌স্বাধীনতা ও মতপ্রকাশের পরিসর সংকুচিত হয়েছে।

তথ্য সুরক্ষা আইন চূড়ান্ত করার ক্ষেত্রে অংশীজনের উদ্বেগ বিবেচনায় নেওয়া প্রয়োজন। তড়িঘড়ি করে একতরফাভাবে নয়, বরং অংশীজন ও বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়ে এবং এ-সংক্রান্ত অন্যান্য দেশের অভিজ্ঞতাকে পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যালোচনা করেই আইন চূড়ান্ত করতে হবে। নিয়ন্ত্রণ নয়, উপাত্ত সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।