এ কেমন রাজনৈতিক সংস্কৃতি

সম্পাদকীয়

রাজনীতিতে যে নীতি-আদর্শ ও পরমতসহিষ্ণুতা বলে একটা বিষয় আছে, সেটি আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব প্রায়ই ভুলে যান। অনেক সময় তাঁদের ভাষাভঙ্গিতে বিনয় ও সৌজন্যবোধের লেশমাত্র থাকে না। বিশেষ করে যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে, সেই দলের নেতারা যুক্তির চেয়ে শক্তি প্রদর্শনকেই অগ্রাধিকার দিয়ে থাকেন।

আগামী জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এখন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিরোধী দল বিএনপি মুখোমুখি অবস্থানে। আওয়ামী লীগ বলছে, দলীয় সরকারের অধীন নির্বাচন হবে। বিএনপির দাবি, সরকারকে পদত্যাগ করে নির্দলীয় সরকারের অধীন নির্বাচন দিতে হবে। নিজ নিজ রাজনৈতিক অবস্থান ব্যাখ্যা করতে দুই দল ও তাদের সহযোগীরা প্রায় প্রতিদিনই কর্মসূচি পালন করছে।

গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সভা-সমাবেশ করার অধিকার সব দল ও সংগঠনেরই আছে। কিন্তু সেই কর্মসূচি নিয়ে পাল্টাপাল্টি কোনোভাবে কাম্য হতে পারে না।

বিএনপি তাদের ১০ দফা দাবির সমর্থনে ঢাকার বাইরে ৯টি বিভাগীয় সমাবেশ করেছে, কোনো সমস্যা হয়নি। কিন্তু বিএনপির ঢাকার কর্মসূচির দিন আওয়ামী লীগ দলীয় নেতা-কর্মীদের পাহারায় বসানোর ঘোষণা দিল। সেই সঙ্গে তারা ঢাকায় দুটি সমাবেশও করেছে। এরপর বিএনপির জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের কর্মসূচির দিনও আওয়ামী লীগ শান্তি সমাবেশ পালন করে। এ নিয়ে দু-একটা স্থানে সংঘাতের ঘটনাও ঘটেছে।

সর্বশেষ বিএনপি ১১ ফেব্রুয়ারি ইউনিয়ন পর্যায়ে পদযাত্রা ঘোষণা করলে আওয়ামী লীগও একই দিন শান্তি সমাবেশের ডাক দিয়েছে। বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বিভিন্ন ওয়ার্ড থেকে দলীয় নেতা-কর্মীরা এসে ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ের সামনে সমবেত হবেন এবং নেতারা দলীয় অবস্থান ব্যাখ্যা করবেন। এ অবস্থায় আওয়ামী লীগ-ঘোষিত শান্তি সমাবেশটি কোথায় হবে? ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ের সামনে অর্থাৎ ইউনিয়নের কেন্দ্রস্থলে হলে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘাতের আশঙ্কা থেকেই যায়।

আমাদের প্রশ্ন হলো, ক্ষমতাসীন দলটি বিরোধী দলের পেছনে পেছনে কেন হাঁটছে? আওয়ামী লীগ তাদের কর্মসূচিটি আগেভাগে ঘোষণা করুক। সে ক্ষেত্রে বিএনপি অন্য দিন কর্মসূচি নিতে পারে। এটা হলো রাজনীতির সৌজন্যবোধ ও সহনশীলতার উদাহরণ। একই সঙ্গে একই স্থানে বড় দুই দল কর্মসূচি নিলে জনগণকেও দুর্ভোগে পড়তে হয়। জনগণের প্রতি ন্যূনতম দরদ ও দায়বোধ আছে—এমন কোনো দল এই পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি নিতে পারে না।

আমরা সামরিক শাসনের সময়ও এ রকম দৃশ্য দেখিনি। সরকারি দল যেদিন কর্মসূচি দিয়ে তাদের নীতি ও অবস্থান ব্যাখ্যা করত, বিরোধী দল তার জবাব দিতে অন্য দিন সমাবেশ করত। আওয়ামী লীগের মতো একটি ঐতিহ্যবাহী দল কেন এই পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি নেবে? এ কেমন রাজনৈতিক সংস্কৃতি?

ক্ষমতাসীনদের উচিত এই পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি পরিহার করে নির্বাচন নিয়ে সৃষ্ট সমস্যার সমাধানে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া। আলোচনা ও সমঝোতা ছাড়া একটি দেশের রাজনীতি কীভাবে চলতে পারে? অতীতে আলোচনার মাধ্যমে নির্বাচনী সমস্যার সমাধান হয়নি বলে ভবিষ্যতে হবে না, এমন কোনো কথা নেই। সরকারি ও বিরোধী দল উভয়কে মনে রাখতে হবে রাষ্ট্রের মালিক জনগণ।

তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে মর্যাদা দিতে না পেরে অতীতে বহু দল জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি না চাইলে রাজনৈতিক সৌজন্যবোধ ও সহনশীলতা বজায় রাখা জরুরি।

জনগণের সার্বভৌমত্ব স্বীকার করে একটি সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন সময়ের দাবি। এই দাবিকে উপেক্ষা করার পরিণতি কারও জন্যই কল্যাণকর হতে পারে না। দেশকে সংঘাতের দিকে ঠেলে দেবেন না।