মূল্যস্ফীতি রোধে সমন্বিত পদক্ষেপ কেন নেই

সম্পাদকীয়

২০২৪–২৫ অর্থবছরের বাজেট পেশের প্রাক্কালে গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) মূল্যস্ফীতির যে চিত্র তুলে ধরেছে, তা খুবই উদ্বেগজনক। সার্বিক মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশ হলেও খাদ্য মূল্যস্ফীতি আরও অনেক বেশি। বছর দুয়েক ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতির বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হলেও সরকার কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিয়েছে বলে জানা নেই।

বাংলাদেশে চাল, ডাল, তেল, চিনিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন গরিব ও সীমিত আয়ের মানুষ। কেননা তাঁদের আয় তেমন বাড়েনি। সিপিডির বিশ্লেষণে দেখা যায়, ধনীদের চালের চেয়ে গরিবের চালের দাম বেশি বেড়েছে। গত সাড়ে পাঁচ বছরে মোটা চালের দাম বেড়েছে ৩০ শতাংশ। ২০১৯ সালের জানুয়ারি মাসে যে মোটা চালের কেজি ছিল ৪০ টাকা, গত মে মাসে তা বিক্রি হয়েছে ৫২ টাকায়। একই সময়ে মিনিকেট ও পাইজাম চালের দাম বেড়েছে যথাক্রমে ১৭ ও ১৮ শতাংশ। ২০১৯ সালের জানুয়ারি মাসের তুলনায় ২০২৪ সালের মে মাসে মসুর ডালের দাম ৯৫ শতাংশ এবং প্যাকেটজাত আটার দাম কেজিতে ৫৪ শতাংশ বেড়েছে। একই সময়ে খোলা সয়াবিনের দাম লিটারে ৮৪ শতাংশ ও পাম তেলের দাম বেড়েছে ১০৬ শতাংশ।

সিপিডির গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামের চেয়ে বাংলাদেশে চালের দাম বেশি। বাংলাদেশে প্রতি কেজি চিনির দাম ১৩০ টাকা। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে চিনির দাম বাংলাদেশি মুদ্রায় ৩৯ টাকা ও যুক্তরাষ্ট্রে ৯৬ টাকা। এর কারণ উচ্চ আমদানি শুল্ক।

কয়েক বছর আগে খবর বের হয়েছিল, দ্রুত অতি ধনী হওয়া তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান শীর্ষে। যাঁরা দ্রুত সময়ে অঢেল সম্পদের মালিক হন, তাঁদের জন্য মূল্যস্ফীতি কোনো সমস্যা নয়। কিন্তু দরিদ্র মানুষের কাছে সেই নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য এখন বিলাসী পণ্যে রূপ নিয়েছে। আগে মাছ–মাংস গরিব মানুষের কাছে বিলাসী পণ্য হিসেবে বিবেচিত হতো। এখন চাল, ডাল, ভোজ্যতেল ও চিনিও নাগালের বাইরে।

খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির জন্য সরকারের নীতিনির্ধারকেরা রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধসহ আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির ওপর দায় চাপিয়ে থাকেন। কিন্তু অন্যান্য দেশ কীভাবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখল? ভারতের মূল্যস্ফীতিও ৫ শতাংশের নিচে। কয়েক বছর আগে দেউলিয়া হয়ে যাওয়া শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। মূল্যস্ফীতি তারা ৬ শতাংশে নামিয়ে এনেছে। এর জন্য তারা কতগুলো শক্ত পদক্ষেপ নিয়েছে, যা বাংলাদেশ সরকার নিতে পারেনি। চিনি বা জ্বালানি তেলে উচ্চ আমদানি শুল্ক ধার্য করার কী যুক্তি থাকতে পারে?

বাজার ব্যবস্থাপনায় অব্যবস্থা ও অনিয়মই এখন নিয়মে পরিণত হয়েছে। ফলে আমদানি পণ্য তো বটেই, দেশে উৎপাদিত পণ্যের বাজারও সিন্ডিকেট তথা গোষ্ঠীবিশেষের হাতে জিম্মি।

এই জিম্মিদশা থেকে বাজারকে উদ্ধার করার উপায় কী। বাজার ব্যবস্থাপনার আধুনিকায়ন ও পণ্যের সরবরাহ নির্বিঘ্ন করা। আমদানি বা দেশীয় পণ্য যেখানে সিন্ডিকেট তৈরি করে খেয়ালখুশিমতো দাম বাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে, সেখানে বিকল্প ব্যবস্থা নিতে হবে। গরিব মানুষ যাতে সাশ্রয়ী দামে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যগুলো কিনতে পারেন, সে জন্য টিসিবির খোলাবাজারে বিক্রয় কার্যক্রম চালু রাখতে হবে সারা দেশে, সব সময়। দু–একটি বড় শহরে মৌসুমি কার্যক্রম কোনো ফল দেবে না।

মূল্যস্ফীতি রোধে প্রয়োজন সমন্বিত ও সর্বাত্মক কর্মসূচি। দুই বছরের ব্যবধানে শ্রীলঙ্কা মূল্যস্ফীতি ৬৯ দশমিক ৮ শতাংশ থেকে ৬ শতাংশে নিয়ে আসতে পারলে আমরা পারব না কেন?