ওরাই আমাদের ভবিষ্যৎ, বেঁচে থাকার প্রেরণা

সম্পাদকীয়

খেলাপি ঋণ আর অর্থ পাচার বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল দুটি সমস্যা। দুদিন আগের খবর হলো, খেলাপি ঋণের পরিমাণ দেড় লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। গত ১৪ বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে সাত গুণ।

অর্থনীতিবিদদের মত হলো, খেলাপি ঋণের সঙ্গে অর্থ পাচারের সম্পর্ক অঙ্গাঙ্গি। আমদানিতে বেশি, রপ্তানিতে কম মূল্য দেখানো, রপ্তানি আয়ের একটা অংশ দেশে না আনা, হুন্ডি—এমন নানাভাবে টাকা পাচার হচ্ছে। আর এর ফল ভোগ করছে দেশের মানুষ। বাজারে আগুন, মশার কামড়ে ডেঙ্গু, সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু, দূষণে একাকার, শিক্ষার নিম্নমান। মানুষ এখন আশা করতে, স্বপ্ন দেখতেও ভয় পায়।

এই যখন অবস্থা, তখন দেশের উত্তরাঞ্চলীয় জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌর এলাকার শংকরবাটী পোল্লাডাঙ্গা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের শুভ উদ্যোগ মন ভরিয়ে দিল। এই বিদ্যালয়েরই এক ছাত্রের বাবা দুর্ঘটনায় পঙ্গু হয়ে গেছেন। মাটির ব্যাংক ভেঙে ছাত্রছাত্রীরা এই বাবাকে ১৩ হাজার ৬১০ টাকা দিয়েছে।

প্রথম আলোর খবর বলছে, ২০২০ সালে ছাত্রছাত্রীরা স্কুলে শিশু সঞ্চয় ব্যাংক ব্যবস্থা চালু করেছিল। তখন থেকে যে যতটা পারে, ততটাই জমা করে মাটির ব্যাংকে। বিপন্ন মানুষকে এই জমানো টাকা দিয়ে সহযোগিতা করে।

এর আগেও করোনাকালে তারা মাটির ব্যাংক ভেঙে এলাকার এক অসহায় নারীর চিকিৎসায় সাড়ে তিন হাজার টাকা দিয়েছিল। ২০২২ সালে সিলেটে বন্যার্তদের জন্য সাড়ে সাত হাজার টাকা দিয়েছিল বন্ধুসভার ত্রাণ তহবিলে। স্কুলশিক্ষকেরা জানিয়েছেন, কাউকে সাহায্য দিতে যখন ব্যাংক ভাঙা হয়, তখন শিক্ষকেরাও এগিয়ে আসেন।

ভেবে দেখুন, সরকারি এসব প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মূলত লেখাপড়া করে স্থানীয় ছেলেমেয়েরা। তাদের অনেকের অভিভাবকেরই নুন আনতে পান্তা ফুরায়। শিশুদের হাতে কয় টাকাই–বা তাঁরা টিফিনের জন্য তুলে দিতে পারেন? সেখান থেকে টাকা বাঁচিয়ে আর্তমানুষের পাশে দাঁড়ানোর এই উদ্যোগ সবার জন্য দৃষ্টান্ত হয়ে রইল।

দুর্নীতিবাজ, ঋণখেলাপি আর অর্থ পাচারকারীদের বাইরেও বাংলাদেশে একটা বৃহৎ জনগোষ্ঠী আছে। তারা বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার প্রতিনিধিত্ব করে। এই দলে কৃষক-মজুর, ন্যায়-নীতিমান শিক্ষক, সৎ ও প্রগতিশীল চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী আছেন। তাঁরা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে উপার্জন করেন।

নীরবে মানুষের জন্য কাজ করে যান। যেকোনো বিপর্যয়ে, দুর্বিপাকে তাঁরা মানুষের পাশে দাঁড়ান। চিকিৎসার ব্যবস্থা করে, চাকরি দিয়ে, অর্থ দিয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াতে মানুষকে সাহায্য করেন। ঝড়ঝঞ্ঝা, বন্যা, অগ্নিকাণ্ডের মতো ঘটনায় দল বেঁধে ঝাঁপিয়ে পড়েন।

এই যে মানুষ হওয়ার শিক্ষা, সেটা তাঁরা পেয়েছেন পরিবার আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে। এত খারাপের ভিড়েও তাঁরা তাই অনন্য। তাঁদের ওপর ভর করে আজও টিকে আছে বাংলাদেশ নামের ৫৫ হাজার বর্গমাইলের দেশটি।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌর এলাকার শংকরবাটী পোল্লাডাঙ্গা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য শুভকামনা। ওরাই আমাদের ভবিষ্যৎ, বেঁচে থাকার প্রেরণা।