অভিযানকারীরা দায় এড়াবেন কীভাবে

সম্পাদকীয়

নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে হত্যা মামলার আসামি ধরার অভিযানে এলিট ফোর্স হিসেবে পরিচিত বাহিনী র‍্যাবের সদস্যদের হাতে আরেকটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটল। এ ঘটনা কেবল উদ্বেগজনক নয়, জননিরাপত্তার প্রতিও গুরুতর হুমকি হিসেবে বিবেচিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। আইন রক্ষায় নিয়োজিত কোনো বাহিনী আসামি ধরার নামে প্রাণহানির ঘটনা ঘটাতে পারে না।

প্রথম আলোর খবরে প্রকাশিত র‌্যাবের ভাষ্য অনুযায়ী, শনিবার দিবাগত রাত দেড়টায় সোনারগাঁয়ের সাদিপুর ইউনিয়নের বরগাঁও এলাকায় সন্দেহভাজন আসামি ধরতে গেলে গ্রামবাসীরা তাদের ওপর হামলা চালান। র‍্যাবের দাবি, হামলাকারীরা আসামি ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলে গ্রামবাসী বাধা দেন। এ সময় স্থানীয় লোকজন দেশি অস্ত্র নিয়ে র‍্যাবের ওপর হামলা চালান। এতে দুই পক্ষের পাল্টাপাল্টি হামলার ঘটনা ঘটে। হট্টগোলের মধ্যে আবুল কাশেম নামের স্থানীয় এক বৃদ্ধ গুলিতে নিহত হন।

র‍্যাবের ভাষ্য যদি সত্যও হয়, গ্রামবাসী তাদের ওপর দেশীয় অস্ত্র নিয়ে হামলা করেছেন, আর তারা এর জবাব দিয়েছে গুলি করে। র‍্যাবের এ অভিযান অনেকগুলো প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। র‍্যাব সেখানে নিজেদের পরিচয় লুকিয়ে সাদাপোশাকে কেন অভিযান চালাতে গেল? কেন রাত দেড়টায় অভিযান চালানোর প্রয়োজন হলো? র‍্যাব সদস্যরা যদি মনে করে থাকেন, দিনের বেলায় অভিযান চালালে আসামি পালিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে; সে ক্ষেত্রে তঁারা ইউনিফর্ম পরেই প্রয়োজনীয়সংখ্যক সদস্য নিয়ে অভিযান চালাতে পারতেন।

গ্রামবাসী যখন র‍্যাব সদস্যদের কাছে পরিচয়পত্র চেয়েছেন, তখন তাঁরা তা দেখালে সমস্যা এত দূর গড়াত না। প্রাণহানির ঘটনাও এড়ানো যেত। র‍্যাব সদস্যরা কেন পরিচয়পত্র দেখাতে গড়িমসি করলেন? গ্রামবাসী যেহেতু পুলিশের জরুরি সেবা বিভাগ ৯৯৯-এ ফোন করেছেন, তাই এটা মনে হওয়া স্বাভাবিক যে তঁারা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকতেই সচেষ্ট ছিলেন। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক যথার্থই বলেছেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সাদাপোশাকে (সাধারণ মানুষের বেশে) কোনো অভিযানে গেলে অবশ্যই পরিচয় দিতে হবে এবং গ্রেপ্তারের কারণ বলতে হবে।

নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে মধ্যরাতে যাঁরা অভিযান চালিয়েছেন, তাঁরা এসবের তোয়াক্কা করেননি। যাঁরা পেশায় দিনমজুর, তাঁরা দুর্ধর্ষ প্রকৃতির লোক হবেন, এ ভাষ্য বিশ্বাস করা কঠিন। র‍্যাব-১১-এর অধিনায়ক তানভীর মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, খুনের আসামি ধরতে র‍্যাবের অভিযানের সময় ‘দুষ্কৃতকারী ব্যক্তিদের’ হামলায় র‍্যাবের চারজন আহত হন।

র‍্যাব-১১-এর জ্যেষ্ঠ ওয়ারেন্ট অফিসার এ ঘটনার পর ২১ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন; যঁাদের মধ্যে র‍্যাবের গুলিতে নিহত আবুল কাশেমের ছেলে নজরুল ইসলাম ও জহিরুল ইসলামও আছেন। ঘটনার সময় আটক হওয়া নজরুল ইসলামকে পরে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে।

সব মিলিয়ে র‍্যাবের মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছেন ছয়জন। আটক থাকায় নজরুল ইসলাম বাবার দাফন ও জানাজায় অংশ নিতে পারেননি। নিজেদের অন্যায় ও অপেশাদারি কর্মকাণ্ড ঢাকতে উল্টো গ্রামবাসীর বিরুদ্ধে এ ধরনের মামলা করা কেবল নিন্দনীয় নয়, অমানবিকও। তা ছাড়া আসামিদের ছোড়া গুলিতে বৃদ্ধ আবুল কাশেম নিহত হয়েছেন—র‍্যাবের এ দাবি জনমনে বিশ্বাসযোগ্যতা পাবে বলে মনে হয় না।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্ব জনগণের জানমালের নিরাপত্তা দেওয়া। নারায়ণগঞ্জে র‍্যাব সদস্যরা যে ঘটনা ঘটিয়েছেন, তাতে কোনোভাবেই পেশাদারত্বের পরিচয় পাওয়া যায়নি। কিছু সদস্যের এমন অপেশাদারি কর্মকাণ্ডের দায় যদি পুরো বাহিনী নিতে না চায়, তবে র‍্যাবেরই উচিত যথাযথ তদন্ত করে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া। নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে র‌্যাবের অভিযান ও আবুল কাশেমের নিহত হওয়ার ঘটনার সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত হোক।