ভুক্তভোগীর জীবনে আরও ঝুঁকি তৈরি করছে

সম্পাদকীয়

নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড হলেও খুব কম অপরাধীই শাস্তি পান। তদন্তের দুর্বলতা ও বিচারের দীর্ঘসূত্রতা এর অন্যতম কারণ। তবে এর চেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো অপরাধীদের বিরুদ্ধে মামলা না হওয়া। অনেক সময় দেখা যায়, ধর্ষণ বা নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটলে স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিরা কথিত সালিসের নামে ভুক্তভোগীর পরিবারকে কিছু টাকা ‘ক্ষতিপূরণ’ দিয়ে এবং অভিযুক্তকে চড়–থাপ্পড় মেরে আইন ও বিচারবহির্ভূতভাবে সেটা মীমাংসা করেন।

প্রথম আলোর খবর থেকে জানা যায়, গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে প্রতিবেশী এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে। পরে সালিসের মাধ্যমে অভিযুক্ত ব্যক্তির কাছ থেকে ১০ হাজার টাকা ‘জরিমানা’ আদায় করা হয়। অন্যদিকে সিরাজগঞ্জের বেলকুচি উপজেলায় প্রতিবন্ধী মেয়েকে ধর্ষণের ঘটনায় সালিসের মাধ্যমে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে ১০ হাজার টাকা জরিমানা ও চড়–থাপ্পড় দিয়ে সেটা মীমাংসা করা হয়েছে। ভুক্তভোগীর বাবা আদালতের কাছে প্রতিকার চাইতেও সাহস পাননি এলাকার প্রভাবশালীদের চোখ রাঙানির ভয়ে।

বেসরকারি সংস্থা মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের (এমএসএফ) তথ্যানুসারে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত সালিসে শাস্তি দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে ৪৪টি। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি—১৩টি সালিস হয়েছে ধর্ষণের ঘটনায়।

এ ছাড়া ধর্ষণচেষ্টার ঘটনার ১১টি এবং অভিযুক্ত ব্যক্তির সঙ্গে ভুক্তভোগীর বিয়ে দেওয়ার একটি সালিসের কথা জানা গেছে। এমএসএফের তথ্যানুসারে, গত ১১ মাসে পাঁচটি বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কের ঘটনায় হিল্লা বিয়ের সিদ্ধান্ত না মানায় একঘরে করার একটি ঘটনা, চরিত্রহীন অপবাদ দেওয়ার দুটি ঘটনা, যৌন হয়রানির দুটি ঘটনা এবং সামাজিক প্রথা না মানায় একঘরে করার দুটি ঘটনায় সালিস হয়েছে। এর মধ্যে সালিসের পর দুজন আত্মহত্যা করেন।

সালিসি বসিয়ে কেউ পারিবারিক বিরোধ মেটাতে পারেন। কিন্তু এভাবে ধর্ষণসহ ফৌজদারি অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে রেহাই দিতে কিংবা রক্ষা করতে পারেন না। পারিবারিক বিষয়েও ফতোয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আছে উচ্চ আদালতের। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামাল বলেছেন, ধর্ষণ এতটাই গুরুতর অপরাধ যে রাষ্ট্র বাদী হয়ে মামলা করতে পারে এবং শাস্তি হতে হবে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে। এ ধরনের অপরাধ মীমাংসা করা বা শাস্তি দেওয়ার এখতিয়ার সালিসকারীদের নেই। বলার অপেক্ষা রাখে না যে অধিকাংশ ক্ষেত্রে সালিসে ধর্ষণের বিচারের রায় নারীর বিপক্ষে যায়।

যেখানে কন্যাশিশু ও নারীরা অহরহ ধর্ষণসহ নানা রকম নির্যাতনের শিকার হচ্ছে, সেখানে আইনের যথাযথ প্রয়োগই প্রত্যাশিত।

কিন্তু বাস্তবে আমরা উল্টোটাই ঘটতে দেখি। আমাদের বিচারপ্রক্রিয়া এতটা জটিল যে সাক্ষ্য আইন সংশোধনের পরও ভুক্তভোগীদের ন্যায়বিচার পাওয়া কঠিন। আর এখানে সালিসের নামে ভুক্তভোগীদের আইনের আশ্রয় নেওয়ার সুযোগই রহিত করে দেওয়া হয়। আসলে প্রভাবশালীরা কথিত সামাজিক শৃঙ্খলা রক্ষার নামে এই অমানবিক সালিস টিকিয়ে রেখেছেন।

এসব সালিসে সব সময়ই প্রভাবশালী ব্যক্তিরা লাভবান হন এবং দুর্বল ভুক্তভোগীরা ক্ষতিগ্রস্ত হন। সালিসের রায় না মানতে পেরে কেউ কেউ আত্মহননের পথও বেছে নেন।

ধর্ষণসহ নারী নির্যাতনের প্রতিটি ঘটনায় মামলা ও সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে অপরাধীদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। কথিত সালিসের নামে যাঁরা ন্যায়বিচারের পথ বন্ধ করছেন, তাঁদেরও জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। তাঁরা যেমন ভুক্তভোগীর জীবনকে আরও বেশি ঝুঁকিতে ফেলেছেন, তেমনি দেশের প্রচলিত আইনি ব্যবস্থাকেও অগ্রাহ্য করছেন।