সত্য উদ্‌ঘাটনে শিক্ষাবিদদের কমিটি হোক

সম্পাদকীয়

সরকার যখন ব্যাংকগুলোতে ঋণের সুদের হার বেঁধে দিয়েছিল, তখন নয়ছয় শব্দটি বেশ চালু হয়েছিল। এখন দেখা যাচ্ছে, কেবল ব্যাংকিং খাত নয়, শিক্ষাসহ সরকারের সব খাতেই নয়ছয় কারবার চলছে। এর সর্বশেষ উদাহরণ প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের ছয় ঘণ্টার মধ্যে আবার সেটি স্থগিতের ঘোষণা।

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে মঙ্গলবার রাত আটটায় এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, কারিগরি ত্রুটির জন্য প্রকাশিত ফলাফল পুনর্যাচাইয়ের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করায় ফলাফল স্থগিত করা হয়েছে।

এরপর বুধবার রাতে সংশোধিত ফলাফল প্রকাশ করা হয়। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের সূত্র বলছে, ফলাফলে ‘কোডিং’-সংক্রান্ত ভুলের কারণে কিছু সমস্যা হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে দেখা গেছে, যার বৃত্তি পাওয়ার কথা, সে পায়নি; আবার যার পাওয়ার কথা নয়, সে বৃত্তি পেয়েছে।

উল্লেখ্য, মঙ্গলবার দুপুরে সচিবালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে বৃত্তি পরীক্ষার ফলাফল ঘোষণা করেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেন। তিনি জানান, ২০২২ সালের প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষায় মোট ৮২ হাজার ৩৮৩ শিক্ষার্থী বৃত্তি পেয়েছে। এর মধ্যে মেধা কোটায় (ট্যালেন্টপুল) বৃত্তি পেয়েছে ৩৩ হাজার শিক্ষার্থী এবং সাধারণ কোটায় পেয়েছে ৪৯ হাজার ৩৮৩ জন।

প্রাথমিক বৃত্তি পাওয়া শিক্ষার্থীরা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রতি মাসে নির্ধারিত পরিমাণে টাকা পায়। এর মধ্যে মেধা কোটায় বৃত্তি পাওয়া শিক্ষার্থী মাসে ৩০০ টাকা এবং সাধারণ কোটায় বৃত্তি পাওয়া শিক্ষার্থীরা মাসে ২২৫ টাকা করে পাবে। এ ছাড়া বৃত্তি পাওয়া সব শিক্ষার্থী বছরে এককালীন ২২৫ টাকা করে পায়। ৪ লাখ ৮২ হাজার ৯০৪ শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ নেয়।

বিস্ময়কর ঘটনা হলো বৃত্তিপ্রাপ্তদের মধ্যে এমন শিক্ষার্থীও আছে, যারা পরীক্ষাও দেয়নি। প্রথম আলোর খবর অনুযায়ী, বগুড়া জেলার গাবতলী উপজেলার পাঁচপাইকা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে বৃত্তি পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার জন্য নিবন্ধন করেছিল এক শিক্ষার্থী। সে পরীক্ষায় অংশ না নিলেও তাকে বৃত্তি (সাধারণ কোটা) পাওয়ার তালিকায় রাখা হয়েছে।

পরীক্ষা না দেওয়া শিক্ষার্থী কীভাবে বৃত্তি পেল? তাহলে মনগড়া ফলাফলের ভূত কি প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগেও চেপে বসেছে? প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগের এ ধরনের আচরণে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন শিক্ষক ও অভিভাবকেরা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইআর) অধ্যাপক এম তারিক আহসান যথার্থই বলেছেন, ‘এ ধরনের ঘটনা শিশুদের প্রতি একধরনের অত্যাচার। এটি করার অধিকার আমাদের নেই।’ প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগ শিশুদের আবেগ–অনুভূতির ওপর সেই অনাধিকার চর্চাই করেছে। তারা শিশুশিক্ষার্থীদের ওপর মানসিক চাপ ও ক্ষতির বিষয়টি আমলেই নেয়নি।

প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের বৃত্তির ফলাফলে নয়ছয়ের বিষয়টি কেবল কারিগরি ত্রুটি ভাবার কারণ নেই। এর পেছনে স্বার্থান্বেষী মহলের কারসাজি ও দুর্নীতি থাকা অস্বাভাবিক নয়। কোমলমতি শিক্ষার্থীদের নিয়ে যাঁরা এ ধরনের দায়িত্বহীন কাণ্ড করেছেন, তাঁদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে।

গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তাদের নিয়ে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ ধরনের কমিটি সত্য উদ্‌ঘাটনের সহায়ক হবে বলে আমরা মনে করি না। প্রকৃত সত্য বের করতে ও অপরাধীদের চিহ্নিত করতে হলে প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নন, এমন কর্মকর্তা, প্রযুক্তিবিদ ও শিক্ষাবিদদের নিয়ে তদন্ত কমিটি করতে হবে।