তৈরি পোশাকশিল্পে অচলাবস্থার অবসান হোক

সম্পাদকীয়

বেতন বাড়ানোর দাবিতে আন্দোলনরত তৈরি পোশাকশিল্পের শ্রমিকদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংঘর্ষে আরও একজন কর্মী মারা গেলেন। এ নিয়ে গত দুই সপ্তাহের ব্যবধানে একজন নারীসহ চার শ্রমিককে জীবন দিতে হলো।

গত বুধবার গাজীপুরের কোনাবাড়ীর জরুন এলাকায় পুলিশের সঙ্গে বিক্ষোভরত শ্রমিকদের সংঘর্ষ হয়। সেখানে জালাল উদ্দিন নামের এক ব্যক্তির শরীরে পুলিশের গুলি লাগে। পরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। তিনি ছিলেন একটি তৈরি পোশাক কারখানার সুপারভাইজার।

প্রথম আলোর খবর থেকে জানা যায়, গত তিন দশকে তৈরি পোশাক রপ্তানি বেড়েছে ২৪ গুণ, অথচ শ্রমিকদের মজুরি বেড়েছে ১৩ গুণ। বর্তমানে তৈরি পোশাক কারখানার শ্রমিকেরা যে আন্দোলনে নেমেছেন, তার পেছনে রয়েছে মজুরি–বঞ্চনা।

সরকার শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ১২ হাজার ৫০০ টাকা ঘোষণা করলে শ্রমিকেরা তা প্রত্যাখ্যান করে আন্দোলনে নামেন। শ্রমিকদের দাবি, সাত বছর পর যে মজুরি বাড়ানো হয়েছে, বর্তমান বাজারদরে তা দিয়ে জীবন নির্বাহ করা সম্ভব নয়। তাঁরা ন্যূনতম মজুরি ২০ হাজার টাকা করার দাবি করেছিলেন।

উল্লেখ্য, চীনে এ শিল্পের শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ৩০৩ ডলার। ভিয়েতনাম, ভারত, কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়ার ন্যূনতম মজুরি যথাক্রমে ১৭০ ডলার, ১৭১ ডলার, ২০০ ডলার ও ২৪৩ ডলার। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশে শ্রমিকদের ১১৩ ডলার খুবই কম।

বলার অপেক্ষা রাখে না যে মালিকদের অনড় মনোভাবের কারণেই পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়েছে। গত ২২ অক্টোবর মজুরি বোর্ডের চতুর্থ সভায় শ্রমিক প্রতিনিধিরা ন্যূনতম মজুরি ২০ হাজার ৩৯৩ টাকা করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। বিপরীতে মালিকপক্ষের প্রতিনিধিরা ১০ হাজার ৪০০ টাকা মজুরি প্রস্তাব দিয়েছিলেন। এর এক দিন পরই আশুলিয়া, মিরপুরসহ দেশের কয়েকটি শিল্পাঞ্চলে শ্রমিক অসন্তোষ তৈরি হয়।

নতুন মজুরি ঘোষণার পরও পোশাকশিল্প খাতে অসন্তোষ না থামায় এটা পরিষ্কার যে নতুন মজুরি তাঁদের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। আমরাও সম্পাদকীয় মন্তব্যে প্রশ্ন তুলেছিলাম যে নতুন নির্ধারিত এই মজুরি কতটা বাস্তবসম্মত ও গ্রহণযোগ্য হলো? বর্তমান মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় নিলে এই বেতন যে বাস্তবসম্মত নয়, তা বুঝতে অর্থনীতিবিদ হওয়ার প্রয়োজন নেই।

পোশাকশিল্পের মালিকেরা দীর্ঘ সময় ধরে নানা সুযোগ-সুবিধা ও ছাড় পেয়ে এলেও শ্রমিকদের মজুরির ব্যাপারে তঁাদের টালবাহানা নতুন কিছু নয়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে সরকারকেও সব সময় মালিকদের স্বার্থ রক্ষার ব্যাপারে বেশি তৎপর দেখা যায়।

তৈরি পোশাকশিল্প বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের সবচেয়ে বড় খাত। কিন্তু শুধু শ্রমিকদের কম মজুরির ওপর ভিত্তি করে একটি শিল্প খাত টেকসই হতে পারে না। মালিক ও সরকারপক্ষকে এই বাস্তবতা বিবেচনায় নিতে হবে। তা ছাড়া অব্যাহতভাবে শ্রমিক অসন্তোষ এই খাতের স্থিতিশীলতাকেও নষ্ট করবে। শ্রমিক অসন্তোষের মধ্যে শুধু ষড়যন্ত্র দেখা কোনো কাজের কথা নয়।

তা ছাড়া আন্দোলন দমনে সরকার শক্তি প্রয়োগের যে কৌশল নিয়েছে, তা দুর্ভাগ্যজনক। এই যে চার-চারটি প্রাণ ঝরে গেল, এর কৈফিয়ত কী? সরকার শ্রমিক বিক্ষোভের কারণ বিবেচনায় না নিয়ে শক্তি প্রয়োগকেই যেন যথার্থ বলে মনে করছে। এ ধরনের অবস্থান কেবল শ্রমিক স্বার্থবিরোধী নয়, শিল্পের জন্যও বিপজ্জনক।

মজুরি নিয়ে তৈরি পোশাক খাতে যে অচলাবস্থা চলছে, অবিলম্বে তার অবসান হওয়া জরুরি। সুপারভাইজার জালাল উদ্দিন ও অপর তিন নিহত শ্রমিকের পরিবারকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দেওয়া হোক। আমরা মনে করি, পোশাক শিল্প খাত, মালিক ও শ্রমিক সবার স্বার্থেই একটি বাস্তবসম্মত মজুরি নির্ধারণ জরুরি।