ফৌজদারি ব্যবস্থার রাজনৈতিক অপপ্রয়োগ

সম্পাদকীয়

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে কিছু সহিংস ও কিছু অস্তিত্বহীন ঘটনায় সারা দেশে যেভাবে মামলা ও গণগ্রেপ্তার বেড়েছে, তাতে উদ্বিগ্ন না হওয়ার কারণ নেই। এর আগেও আমরা দেখেছি, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে-পরে এবং নানা সময়ে বিএনপির রাজনৈতিক কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে এ ধরনের মামলা ও গ্রেপ্তারের ঘটনা ঘটেছে।

‘গায়েবি মামলা’ বলে পরিচিতি পাওয়া এই মামলা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়, এ বিষয়ে বাস্তব ও বিশ্বাসযোগ্য অভিযোগ থাকার পরও তা বন্ধে কোনো উদ্যোগ দেখতে না পাওয়াটা যারপরনাই হতাশাজনক। এটি নিশ্চিতভাবেই ফৌজদারি বিচারব্যবস্থার রাজনৈতিক অপব্যবহার। শুধু রাজনৈতিক কর্মীরাই নন, তাতে সাধারণ মানুষও ভুক্তভোগী হচ্ছেন।

গাজীপুর, মাগুরা ও যশোর—এই তিন জেলার পরিস্থিতি নিয়ে প্রথম আলো গতকাল দুটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। দেখা যাচ্ছে যে অক্টোবর মাসে বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা ও ধরপাকড় বেড়েছে। যেখানেই মামলা হোক, এজাহারের ভাষা প্রায় হুবহু এক। ঘটনাস্থলে গিয়ে অনেক ঘটনার সত্যতাই পাওয়া যায়নি। অধিকাংশ ক্ষেত্রে যাঁদের সাক্ষী করা হয়েছে, তাঁরা ঘটনা সম্পর্কে জানেন না। কয়েকজনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতসংখ্যক মানুষকে আসামি করা হয়েছে। কারাগারে থাকা কিংবা প্রবাসী ব্যক্তিদেরও মামলায় আসামি করা হয়েছে।

যশোরে অক্টোবর মাসের প্রথম ১৩ দিনে সরকার উৎখাত ও নাশকতার অভিযোগে ১২টি মামলা হয়েছে। জ্ঞাত-অজ্ঞাত মিলিয়ে এসব মামলায় আসামি ৯৫০ জন। গ্রেপ্তার করা হয়েছে ১০৫ জনকে। উচ্চ আদালত থেকে অনেকে জামিন নিয়েছেন।

২ নভেম্বর মাগুরার মহম্মদপুর থানায় নাশকতা ও ককটেল বিস্ফোরণের অভিযোগে পুলিশ একটি মামলা করে। এই মামলায় এমন একজন ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে, যিনি বাহরাইনপ্রবাসী। গাজীপুরের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, ৩১ অক্টোবর টঙ্গী থানায় নাশকতার মামলায় এমন দুজনকে আসামি করা হয়েছে, যাঁরা আগে থেকেই কারাগারে আছেন।

এ বিষয়ে পুলিশের ভাষ্য হচ্ছে, ঘটনাস্থল থেকে আটক ব্যক্তিদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে এঁদের আসামি করা হয়েছে। তদন্ত-পরবর্তী সময়ে সংশ্লিষ্টতা পাওয়া না গেলে আসামির তালিকা থেকে নাম বাদ দেওয়া হবে। এ ভাষ্য থেকেই স্পষ্ট যে পুলিশ তদন্ত না করেই নিজেদের খেয়ালখুশিমতো আসামি করেছে। এ তিন জেলা শুধু নয়, ঢাকাসহ সারা দেশের চিত্র প্রায় একই।

ডিএমপি, আদালত সূত্র ও প্রথম আলোর প্রতিনিধিদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২৮ অক্টোবর বিএনপির সমাবেশ ঘিরে ঘটা সহিংসতার পর ৬ নভেম্বর পর্যন্ত সারা দেশে দলটির ৮ হাজার ১৩৩ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এই ৯ দিনে ঢাকায় ১০২টি মামলা হয়, গ্রেপ্তার করা হয় ১ হাজার ৫৫৪ জনকে।

গত বছরের অক্টোবর-নভেম্বর মাস থেকে গায়েবি মামলা বাড়ছিল। ২২ জুলাই প্রথম আলোয় প্রকাশিত ‘নির্বাচনের আগে এবারও গায়েবি মামলা’ শিরোনামের প্রতিবেদনে দেখা যায়, গত বছর নভেম্বর মাস থেকে এ বছরের মে মাসে শুধু ঢাকা মহানগরে এ ধরনের ৫০টি মামলা হয়।

১৭টি মামলা সরেজমিনে তদন্ত করে প্রতিবেদক দেখেন, ১৫টি ক্ষেত্রেই স্থানীয় লোকজন বলেছেন যে পুলিশ বা আওয়ামী লীগের ওপর হামলা বা ককটেল বিস্ফোরণের কোনো ঘটনা তাঁরা দেখেননি বা শোনেননি। অথচ এসব মামলায় বিএনপির নেতা-কর্মীদের সঙ্গে অজ্ঞাতসংখ্যক মানুষকে আসামি করা হয়।

মামলা গায়েবি হলেও ভুক্তভোগী মানুষগুলো বাস্তবের। অস্তিত্বহীন ঘটনায় মামলা ও গ্রেপ্তার মানবাধিকার লঙ্ঘনের সুস্পষ্ট দৃষ্টান্ত। দেশের নাগরিকদের সংবিধান যে মৌলিক অধিকার দিয়েছে, তার লঙ্ঘন। ফৌজদারি বিচারব্যবস্থার এমন রাজনৈতিক অপপ্রয়োগ অবশ্যই বন্ধ করতে হবে।