আর্থিক ও সামাজিক বাধা দূর করতে হবে

সম্পাদকীয়

মুঠোফোন সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর বৈশ্বিক সংগঠন গ্লোবাল সিস্টেম ফর মোবাইল কমিউনিকেশনস অ্যাসোসিয়েশনের (জিএসএমএ) ‘দ্য মোবাইল জেন্ডার গ্যাপ রিপোর্ট ২০২৪’-এ বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারের যে তথ্য উঠে এসেছে, তা খুবই হতাশাব্যঞ্জক।

এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে মুঠোফোনে ইন্টারনেট সেবা গ্রহণে নারী-পুরুষের ব্যবধান বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি। জিএসএমএ বলছে, বাংলাদেশের ৪০ শতাংশ পুরুষ ও ২৪ শতাংশ নারী মুঠোফোনে ইন্টারনেট ব্যবহার করছেন। এ হার ভারতে ৫৩ ও ৩৭ শতাংশ, ইন্দোনেশিয়ায় ৬৯ ও ৬৩ শতাংশ, পাকিস্তানে ৫৩ ও ৩৩ শতাংশ। এর অর্থ বাংলাদেশের ৬০ শতাংশ পুরুষ ও ৭৬ শতাংশ নারী মুঠোফোনে ইন্টারনেট সেবার বাইরে আছেন।

২০২০ সালের প্রতিবেদনে দেখা যায়, দেশের ৩৩ শতাংশ পুরুষ মুঠোফোনে ইন্টারনেট ব্যবহার করতেন, আর নারীদের মধ্যে এই হার ছিল ১৬ শতাংশ। সে ক্ষেত্রে ইন্টারনেটের ব্যবহার কিছুটা বেড়েছে, যদিও তা প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় অনেক কম। সে সময় ৩৬ শতাংশ পুরুষ যেখানে স্মার্টফোন ব্যবহার করতেন, সেখানে নারীদের মধ্যে এ ফোন ব্যবহারের হার ২১ শতাংশ। আর বেসিক ফোন ব্যবহারকারী পুরুষ ১৯ শতাংশ এবং নারী ১৩ শতাংশ। অন্যদিকে বাংলাদেশে ৮৫ শতাংশ পুরুষ ও ৬৮ শতাংশ নারী মুঠোফোনের মালিক। এর অর্থ ৩২ শতাংশ নারী মুঠোফোন ব্যবহারই করেন না।

জিএসএমএ নিম্ন ও মধ্যম আয়ের ১২টি দেশের তথ্য প্রকাশ করেছে। দেশগুলো যথাক্রমে মিসর, ইথিওপিয়া, কেনিয়া, সেনেগাল, নাইজেরিয়া, উগান্ডা, বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, গুয়াতেমালা ও মেক্সিকো।

আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সাল থেকেই ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার কথা বলে আসছে; কিন্তু ইন্টারনেট ও স্মার্টফোন ব্যবহারে পিছিয়ে থেকে সেটি কি সম্ভব? এর সঙ্গে নাগরিকের আর্থিক সামর্থ্যের বিষয়টি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সরকারি হিসাবেই ১৮ শতাংশের বেশি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করেন। সে ক্ষেত্রে আমরা ধরে নিতে পারি, ব্যতিক্রম ছাড়া এই শ্রেণির পুরুষ ও নারীরা স্মার্টফোন ও ইন্টারনেট সেবার বাইরে। জিএসএমএর গবেষণায় উঠে এসেছে, মুঠোফোন ও ইন্টারনেট প্যাকেজের বাড়তি দাম বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারে বড় বাধা।

স্মার্টফোন ও ইন্টারনেট ব্যবহারে নারীর পিছিয়ে থাকার কারণ মূলত আর্থিক ও সামাজিক। প্রথম আলোর প্রতিবেদনেই এসেছিল, এক শ্রমজীবী নারী নিজের আয় দিয়ে স্বামীকে স্মার্টফোন কিনে দিলেও, সেই ব্যক্তি চান না স্ত্রীরও আরেকটি স্মার্ট ফোন থাকুক। এ ছাড়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানা রকম যৌন হয়রানি ও মানসিক নিগ্রহের শিকার হতে পারেন, এই ভয়েও অনেক নারী স্মার্টফোন ও ইন্টারনেট ব্যবহার থেকে বিরত থাকেন।

যেসব নারী তৈরি পোশাকশিল্পে কাজ করেন, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় খুব এগিয়ে না থাকলেও তাঁদের বেশির ভাগ স্মার্টফোন ব্যবহার করেন। অন্যদিকে যেসব নারী ঘরের বাইরে কাজ করেন না, লেখাপড়ায় অগ্রসর হলেও তাঁরা স্মার্টফোন ও ইন্টারনেট ব্যবহারে উৎসাহিত হন না।

নারী ও পুরুষ সমাজের সম–অংশীদার। তাঁদের কাউকে পেছনে রেখে সমাজ এগিয়ে যেতে পারে না। অতএব নারীর স্মার্টফোন ও ইন্টারনেট ব্যবহারের হার বাড়াতে হলে তাঁদের যেমন আর্থিকভাবে সামর্থ্যবান করে তুলতে হবে, তেমনি পারিবারিক ও সামাজিক বাধাগুলোও দূর করতে হবে। শত বছর আগে রবীন্দ্রনাথ নারীকে আপন ভাগ্য জয় করার অধিকার দেওয়ার কথা বলেছেন। রাষ্ট্র, পরিবার ও সমাজের সর্ব ক্ষেত্রে সেই অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। অন্যথায় সরকার ঘোষিত ডিজিটাল কিংবা স্মার্ট বাংলাদেশ কথার কথাই থেকে যাবে।