পুনর্বাসন ও পুনর্গঠনের দিকে মনোযোগ দিন

সম্পাদকীয়

ভয়াবহ বন্যার শিকার হয়ে এখনো ধুঁকছে সিলেট ও সুনামগঞ্জের বিস্তীর্ণ এলাকা। এ অঞ্চল কখন আবার আগের অবস্থায় ফিরে যেতে পারবে, তা এখনো অনিশ্চিত হয়ে আছে। ভবিষ্যতে আবারও এমন দুর্যোগ রুখতে কতটা টেকসই পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে, সেটিও ভেবে দেখার বিষয়।

দুর্যোগপ্রবণ দেশ হলেও ত্রাণসহায়তা দিয়ে পরিস্থিতি মোকাবিলাকেই প্রাধান্য দিয়ে এসেছি আমরা। প্রাথমিকভাবে সেটি জরুরি হলেও দুর্যোগ–পরবর্তী পুনর্বাসন প্রক্রিয়াটিই হচ্ছে মূল কাজ। একই সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি ও জটিলও। যার কারণে প্রস্তুতি, পরিকল্পনা ও বরাদ্দ সবকিছু হলেও বাস্তবায়নে ঘাটতি থেকে যায়।

সিলেট, সুনামগঞ্জ ও অন্যান্য জেলায় বন্যায় ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে প্রথম আলো একাধিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। বন্যা শুরু হওয়ার এক মাস পেরিয়ে গেলেও দুই জেলায় এখনো সাত-আট হাজারের মতো মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান করছে। সরকারি আশ্রয়কেন্দ্রের বাইরে এ হিসাব আরও বেশি। অনেক এলাকায় এখনো বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। অনেকে ঘরবাড়ি হারিয়ে নানা জায়গায় আশ্রয় নিয়েছেন।

বন্যায় সরকারি হিসাবে সিলেট জেলায় ৪০ হাজার এবং সুনামগঞ্জে ৪৫ হাজারের বেশি ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বাস্তবে ক্ষতিগ্রস্ত ঘরবাড়ির সংখ্যা আরও বেশি। অথচ এর মধ্যে দুই জেলায় ১২ হাজারের মতো ঘর পুনর্নির্মাণ কিংবা সংস্কারের জন্য সরকারি বরাদ্দ এসেছে। সরকারি হিসাব অনুসারে ক্ষতিগ্রস্ত ঘরের অল্পসংখ্যক মালিক এ অনুদান পেয়েছেন। আমরা চাই সরকারি হিসাবে ক্ষতিগ্রস্ত সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করা হোক। ক্ষতিগ্রস্ত কেউ যাতে সরকারি সহায়তা থেকে বঞ্চিত না হয়।

বন্যায় সিলেট ও ময়মনসিংহ বিভাগের জেলাগুলোসহ দেশের ১৭ জেলার সড়ক কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যার ৮৫ শতাংশই সিলেট বিভাগে। ভেঙে গেছে বহু সেতু ও কালভার্ট। এসব সড়ক এখনো সংস্কার হয়নি। যোগাযোগব্যবস্থার এমন বেহালে চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন এসব এলাকার মানুষ। ব্যাহত হচ্ছে পণ্য পরিবহনও।

করোনা পরিস্থিতির পর বন্যায় শিক্ষা ক্ষেত্রে যে ক্ষতি হয়েছে, সেটি মোকাবিলা করা সবচেয়ে চ্যালেঞ্জের। সরকারি হিসাবে, সিলেট বিভাগের ৬৮২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে সংস্কার ছাড়া ৫২৮টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠদান সম্ভব নয়। ফলে এর মধ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে গেলেও অনেক জায়গায় এখনো পাঠদান শুরু করা সম্ভব হয়নি। স্কুল খুললেও শিক্ষার্থীদের উপস্থিতির হার ২৫ থেকে ৪০ শতাংশ। ফলে শিক্ষার্থীদের স্কুলে ফিরিয়ে আনার দিকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ সরকারের সংশ্লিষ্ট সবাইকে সর্বোচ্চ মনোযোগ দিতে হবে।

জাতিসংঘের হিসাবে, সাম্প্রতিক বন্যায় দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ৭২ লাখের বেশি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের জন্য ৫০ লাখ ডলারের সহায়তা ঘোষণা দিয়েছে সংস্থাটি। বন্যায় অনেক মানুষ ধান, গবাদিপশু ও খামারের মাছ হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছে। অনেকে হয়ে পড়েছেন কর্মসংস্থানহীন।

ত্রাণসহায়তা, পুনর্বাসন ও সামাজিক সুরক্ষার জন্য এনআইডি কার্ড একটি অপরিহার্য নথি, আকস্মিক ও অভাবিত বন্যার পানিতে সেটিও ভেসে গেছে অনেকের। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত এতগুলো মানুষকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে সরকারকে পরিকল্পিত ও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। সরকারি ও বেসরকারি সব বরাদ্দ যাতে পুরোপুরি ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের কাছে পৌঁছায়, যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে সেটি নিশ্চিত করা হোক।

অসংখ্য নলকূপ নষ্ট হয়েছে, অনেক স্বাস্থ্যকেন্দ্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষয়ক্ষতির তালিকাটি আসলে দীর্ঘ। ফলে বন্যাকবলিত এলাকাগুলোকে আবারও আগের অবস্থায় ফিরে আনতে আলাদা কোনো কমিশন গঠন করার কথা সরকারের বিবেচনা করা উচিত বলে আমরা মনে করি।

যে কমিশন সরকারের সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর ও বিভাগকে সমন্বয় করে পুনর্বাসনের কাজটি এগিয়ে নেবে। পুনর্বাসনের বিশাল এ কাজে অনিয়ম রোধেও সরকারকে সচেষ্ট থাকতে হবে। পুনর্বাসনপ্রক্রিয়ায় যাতে কোনো বৈষম্য তৈরি না হয়, সেটিও নিশ্চিত করতে হবে।