নিবন্ধনের নামে যেন হয়রানি না হয়

২০১০ সালের শিক্ষানীতিতে প্রাথমিক শিক্ষা সর্বজনীন, বাধ্যতামূলক, অবৈতনিক ও সবার জন্য একই মানের হবে বলে ঘোষণা দেওয়া হলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি। সর্বজনীন একমুখী প্রাথমিক শিক্ষার কথা বলা হয়েছিল ১৯৭৪ সালের কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশনেও। কিন্তু সেই সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা অধরাই থেকে গেছে। এখন যাঁর পয়সা নেই, তাঁর পক্ষে সন্তানের জন্য গুণগত শিক্ষার ব্যবস্থা করা কঠিন।

প্রথম আলোর খবর থেকে জানা যায়, দেশে প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে ১ লাখ ১৪ হাজার ৫৩৯টি। যার মধ্যে সরকারি ৬৫ হাজার ৫৬৬টি। বাকি ৪৮ হাজার ৯৭৩টি কিন্ডারগার্টেনসহ বেসরকারি বিদ্যালয়। শহরাঞ্চলে বেশির ভাগ শিক্ষার্থী পড়াশোনা করে বেসরকারি বিদ্যালয়ে। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় চলে সরকারি বিধিবিধান ও পাঠ্যক্রম অনুযায়ী। সেখানে শিক্ষা বিভাগের কর্মকর্তা ও শিক্ষকদের কিছু নিয়মবিধি মেনে চলতে হয়। কিন্তু বেসরকারি বিদ্যালয়গুলোতে সেসবের বালাই নেই। বেসরকারি বিদ্যালয়গুলোর পাঠ্যবই ও পাঠ্যক্রমও ভিন্ন। অনেক বেসরকারি বিদ্যালয়ের পাঠ্যবই নিয়েও প্রশ্ন আছে।

সরকারি হিসাব অনুযায়ী, বেসরকারি বিদ্যালয়গুলোর প্রায় ৯০ ভাগেরই নিবন্ধন নেই। অর্থাৎ এসব বিদ্যালয়ের ওপর সরকারের কোনো নজরদারিই নেই। কেন এত দিন ধরে এসব বিদ্যালয়কে নিবন্ধনের আওতায় আনা যায়নি, সেটিই আমাদের অবাক করে।

বিদ্যালয়গুলোকে নিবন্ধন ছাড়া চলতে দিয়ে কেন সমাজে একধরনের ‘শিক্ষা–বাণিজ্য’ তৈরি করা হলো? এভাবে বিশৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে শিশুর প্রারম্ভিক শিক্ষাজীবন শুরু হলে কীভাবে তার পরবর্তী শিক্ষাজীবন মজবুত হবে। তবে দেরিতে হলেও সরকার বেসরকারি বিদ্যালয়গুলোকে যে নিবন্ধনের আওতায় আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তা সঠিক বলে মনে করি।

বৃহস্পতিবার প্রাথমিক ও গণশিক্ষাসচিব ফরিদ আহাম্মদ বলেছেন, ‘আমরা চাইছি ২০২৪ সালের ‌১ জানুয়ারির পর থেকে যেন একাডেমিক স্বীকৃতিবিহীন ও নিবন্ধনবিহীন কোনো বেসরকারি বিদ্যালয় না চলে।’ তাঁর ভাষ্য অনুযায়ী, বিধিমালা জারির পর তিন মাসের মধ্যে সবাইকে নিবন্ধন ও একাডেমিক স্বীকৃতির জন্য আবেদন করতে বলা হবে। 

আগামী শিক্ষাবর্ষের বাকি মাত্র সাড়ে তিন মাস। এখন পর্যন্ত প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় বিধিমালাই তারা চূড়ান্ত করতে পারেনি। সে ক্ষেত্রে ২০২৪ সালের মধ্যে নিবন্ধন বাধ্যতামূলক কেবল অযৌক্তিক নয়, অসম্ভবও। কাজটি করতে হবে পর্যায়ক্রমে। 

 বেসরকারি হওয়ায় কত টাকা বেতন (টিউশন ফি) নেওয়া হবে, সেটি সরকার নির্ধারণ করে দেবে না বলে জানিয়েছেন সচিব। সরকার শিক্ষার্থীদের বেতন (টিউশন) ফি বেঁধে না দিলেও এ ক্ষেত্রে বেসরকারি বিদ্যালয়গুলোর মধ্যে একটা সামঞ্জস্য থাকা প্রয়োজন বলে আমরা মনে করি। একই সঙ্গে বেসরকারি বিদ্যালয়গুলোকে তদারক ও জবাবদিহির নামে অযাচিত হস্তক্ষেপও কাম্য নয়। আর আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির যুগে নিবন্ধনের কাজটি সম্পন্ন হতে হবে অনলাইনে। যেখানে শারীরিক উপস্থিতি, সেখানেই দুর্নীতির আশঙ্কা থাকে। নিবন্ধনের নামে প্রশাসনিক কার্যক্রমে দীর্ঘসূত্রতা, অযাচিতভাবে ফাইল আটকে রাখা, কোনো ধরনের অবৈধ লেনদেন, শর্ত পূরণ না করা সত্ত্বেও কোনো বিদ্যালয়কে অনুমোদন দেওয়া, আবার শর্ত পূরণ করেও কোনো বিদ্যালয়কে নিবন্ধন দিতে গড়িমসি করা—এমন বিষয়গুলোর প্রতি সতর্ক থাকতে হবে।

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় বেসরকারি বিদ্যালয়গুলোকে যখন একধরনের নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আনতে যাচ্ছে, সেখানে সরকারি বিদ্যালয়গুলোর অবস্থা কী। ঢাকাসহ শহরাঞ্চলের অভিভাবকেরা কেন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের ভর্তি করাতে উৎসাহী নন, সেটাও খতিয়ে দেখতে হবে। বেশির ভাগ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবস্থা খুবই করুণ। এ অবস্থায় বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে নিবন্ধনের আওতায় আনার পাশাপাশি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার মানোন্নয়নেও মনোযোগী হতে হবে। তবে সেটা তখনই সম্ভব হবে, যখন সব প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রয়োজনীয় শ্রেণিকক্ষ, শিক্ষা সরঞ্জাম ও উপযুক্ত শিক্ষক থাকবেন। যেখানে বিদ্যালয়ে পাঠদানের উপযুক্ত শ্রেণিকক্ষ নেই এবং প্রয়োজনীয় শিক্ষকের ঘাটতি আছে, সেখানে শিক্ষার্থীরা মানসম্পন্ন শিক্ষা পাবে কীভাবে?