শিশুর বিকাশ ও অধিকার নিশ্চিত করুন

কবি বলেছিলেন, ‘ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুরই অন্তরে।’ এর মাধ্যমে তিনি প্রতিটি শিশুর মধ্যে যে পূর্ণাঙ্গ মানুষ হওয়ার স্বপ্ন ও সম্ভাবনা অছে, সেটাই বোঝাতে চেয়েছেন। আমরা এখানে শিশুর পিতার জায়গায় শিশুর মাতা কথাটিও যোগ করতে পারি।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০২২ সালের খানা আয়-ব্যয় জরিপ (এইচআইইএস) অনুযায়ী, জাতীয় দারিদ্র্যের হার ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ। এর অর্থ জনসংখ্যার এক–পঞ্চমাংশের কাছাকাছি মানুষ দরিদ্র, যাদের পক্ষে সন্তানদের খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা ও শিক্ষার মতো মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ করা সম্ভব হয় না। বাধ্য হয়ে অনেক শিশুকে গৃহকর্মের মতো ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে হয়।

বুধবার বাংলাদেশ অভিবাসী মহিলা শ্রমিক অ্যাসোসিয়েশন (বমসা) আয়োজিত কর্মশালায় জানানো হয়, শহরে বাসাবাড়িতে স্থায়ী গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করা কর্মীদের মধ্যে ৮০ শতাংশ অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়ে বা শিশু। গৃহকর্তার সঙ্গে ৯৫ শতাংশ গৃহকর্মীর লিখিত চুক্তি নেই। ৯৫ শতাংশ গৃহকর্মী নিয়োগকর্তাদের দ্বারা নিষ্পেষিত, শারীরিক নির্যাতনের শিকার ২১ শতাংশ এবং মৌখিক নির্যাতনের শিকার ৬১ শতাংশ। গত বছর বিলসের অপর সমীক্ষায় বলা হয়, ৮৪ শতাংশ গৃহকর্মী দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করেন। গৃহশ্রমিকের সুরক্ষা ও কল্যাণ নিশ্চিত করতে সরকার ২০১৫ সালে একটি নীতিমালা তৈরি করে। এটি আইনে রূপান্তর এখন সময়ের দাবি বলে মনে করি।

বাংলাদেশের শিশুরা যেসব কাজ করে বা করতে বাধ্য হয়, তার মধ্যে গৃহকর্ম সবচেয়ে অবমাননাকর। বাংলাদেশে গৃহকর্মীর সঠিক হিসাব নেই। তবে শিশুশ্রম নিয়ে যাঁরা কাজ করেন, তাঁদের মতে, দেশে ৭৫ লাখ গৃহকর্মী আছে। প্রকৃত সংখ্যা এর বেশিই হবে। শিশু আইনে ১৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের হালকা কাজে নিয়োগ করার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু গৃহকর্ম পেশা কোনোভাবেই হালকা কাজ নয়। গৃহকর্মীদের কাজেরও কোনো সময়সীমা নেই। ঘুমানোর সময়টুকু বাদ দিলে সারাক্ষণই তাদের কাজ করতে হয়।

আরও উদ্বেগের বিষয়, ঢাকা শহরে যেসব গৃহকর্মী কাজ করে, তাদের ৭১ শতাংশ কন্যাশিশুই পেটে-ভাতে। বাকি যে ২৯ শতাংশ কন্যাশিশু গৃহকর্মে কাজ করে, তারা ৫০০ থেকে সর্বোচ্চ ২ হাজার টাকা পর্যন্ত পারিশ্রমিক পায়। এই শিশুদের পুষ্টি ও স্বাস্থ্যের বিষয়টি কখনো দেখা হয় না। অনেক শিশুকে রাখা হয় খুবই অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে।

বাংলাদেশে ১৪ বছর বয়সী শিশুদের কাজে নিয়োগ নিষিদ্ধ হলেও অনেক সময় ৫-১৩ বছর বয়সী শিশুকে দিয়েও গৃহকর্ম করানো হয়। এই শিশুরা লেখাপড়ার কোনো সুযোগ পায় না, আবার কাজের সামান্য ভুলত্রুটির কারণে তাদের নির্যাতনের শিকার হতে হয়।

আমরা যদি শিশুদের ভবিষ্যতের কথা ভাবি, তাদের যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে চাই, গৃহকর্মসহ ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় যারা আছে, তাদের ভরণপোষণের দায়িত্ব রাষ্ট্রকেই নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে দুটি বিকল্প হতে পারে। অভিভাবকেরা যাতে এসব শিশুকে নিজেদের দায়িত্বে নিয়ে লেখাপড়া করাতে পারেন, সে জন্য তাঁদের আর্থিক সহায়তা দেওয়া। স্কুলপড়ুয়া শিশুদের দুপুরের খাবার দেওয়াকে এর প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে
দেখা যেতে পারে। দ্বিতীয়ত সরকারি ব্যবস্থাপনায় রেখে এই শিশুদের পুনর্বাসন করা।

যেকোনো উপায়ে হোক, শিশুদের গৃহকর্মের মতো ঝুঁকিপূর্ণ ও অবমাননাকর পেশা থেকে মুক্তি দিতেই হবে।