চার ধাপে অনুষ্ঠিত উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের প্রতি জনগণের যে তেমন আগ্রহ ছিল না, সেটা ভোটার উপস্থিতির হার থেকেই ধারণা করা যায়। যে নির্বাচনটি প্রায় প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন এবং ভোটের ফলাফল আগেই জানা, সেই নির্বাচনে আগ্রহ থাকারও কোনো কারণ নেই। তবে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান পদে যাঁরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন, তাঁদের সম্পদ ও আয়ের অবিশ্বাস্য উল্লম্ফন সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে প্রার্থী ও নতুন নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হলফনামা বিশ্লেষণ করে যেসব তথ্য উত্থাপন করেছে, তাতে দেখা যায়, গত পাঁচ বছরে অস্থাবর সম্পদ বৃদ্ধিতে তাঁরা সংসদ সদস্যদেরও পেছনে ফেলেছেন। উপজেলায় এ সময়ে তিন গুণের বেশি কোটিপতি প্রার্থী বেড়েছে।
সম্পদ বৃদ্ধির উদাহরণ তুলে ধরে টিআইবি বলেছে, গত পাঁচ বছরে একজন সংসদ সদস্যের অস্থাবর সম্পদ বৃদ্ধির হার ছিল সর্বোচ্চ ৩ হাজার ৬৫ শতাংশ। অথচ ঝালকাঠি সদর উপজেলার চেয়ারম্যান খান আরিফুর রহমানের সম্পদ বেড়েছে ১১ হাজার ৬৬৬ শতাংশ। ২০১৯ সাল থেকে শতভাগ বা তার বেশি সম্পদ বৃদ্ধি পাওয়া ১৯১ জন এবার উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন।
টিআইবির বিশ্লেষণ বলছে, নির্বাচিত চেয়ারম্যানদের ৩০ দশমিক ৪১ শতাংশ কোটিপতি। পাঁচ বছরে কোটি টাকার ওপরে অস্থাবর সম্পদ বেড়েছে ৫১ জন প্রার্থীর এবং ১০ বছরে বেড়েছে ৪১ জনের। স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন আসে, গরিব দেশের স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা এত ধনী হন কী করে?
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ীদের ৬৭ শতাংশ ব্যবসায়ী। উপজেলা নির্বাচনে জয়ীদের ৬৯ শতাংশ ব্যবসায়ী। অর্থাৎ এখানেও উপজেলা পরিষদের নির্বাচিত চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যানরা এগিয়ে আছেন। উপজেলা নির্বাচনে ১ হাজার ৮৬৪ জন চেয়ারম্যান প্রার্থী, ২ হাজার ৯৫ জন ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থী এবং ১ হাজার ৫১৩ জন নারী ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থীর হলফনামা বিশ্লেষণ করেছে বলে জানিয়েছে টিআইবি।
প্রার্থীরা হলফনামায় যেসব তথ্য–উপাত্ত তুলে ধরেছেন, সেটা শতভাগ সত্য ধরে নেওয়া ঠিক হবে না। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি হলো আয়কর কম দেওয়ার জন্য অনেকেই সম্পদ ও আয় কম করে দেখান। প্রায় ৮৪ শতাংশ প্রার্থীর হলফনামার সঙ্গে আয়কর রিটার্নের সম্পদের হিসাবে পার্থক্য দেখা যায়। আয়কর রিটার্ন ও হলফনামা—দুটির মধ্যে যে শুভংকরের ফাঁকি আছে, তাতে সন্দেহ নেই। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তদন্ত করে দেখা উচিত উপজেলা নির্বাচনের প্রার্থীরা আয় ও সম্পদের যে তথ্য তুলে দিয়েছেন, সে অনুযায়ী তাঁরা আয়কর দেন কি না।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান যথার্থই বলেছেন, জনপ্রতিনিধিত্ব জনস্বার্থকে কেন্দ্র করে যে হওয়ার কথা, সেটি আসলে বাস্তবে নেই। এখন ক্ষমতাকেন্দ্রিক জনপ্রতিনিধিত্ব ক্ষমতায় থাকতে পারলে সম্পদ বিকাশের অবাধ সুযোগ পান।
আমরা উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করছি, স্থানীয় সরকারব্যবস্থা যত দুর্বল হচ্ছে, নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সম্পদের পরিমাণ তত বাড়ছে। এর অর্থ স্থানীয় সরকারের সুফলটা ব্যক্তি ও গোষ্ঠীবিশেষের কাছে চলে যাচ্ছে। বৃহত্তর জনগণ বলতে গেলে কিছুই পাচ্ছেন না। যখন সব দল ও পক্ষের অংশগ্রহণে অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন হতো, তখন স্থানীয় সরকার সংস্থায় যে ক্ষমতার ভারসাম্য ছিল, এক দশক ধরে সেটাও আর নেই। একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত স্থানীয় সরকার সংস্থাগুলো স্বেচ্ছাচারী কায়দায় চলছে। অনেক ক্ষেত্রেই ক্ষমতাসীন দল ও স্থানীয় সরকার সংস্থার ফারাকটি মুছে যাচ্ছে। এটা কেবল স্থানীয় সরকার নয়, সামগ্রিক শাসনব্যবস্থার জন্যও অত্যন্ত বিপজ্জনক।