বসুরহাট কি মগের মুল্লুক

সম্পাদকীয়

‘মানুষই নামকে জাঁকাইয়া তোলে’—এই অযুতবিশ্রুত রবীন্দ্র-বাণীতে ‘জাঁকাইয়া’ তোলা বলতে ব্যক্তির নামকে মহত্তর কাজের মাধ্যমে সর্বব্যাপী সুখ্যাতিতে প্রতিষ্ঠা করার কথা বলা আছে। কিন্তু আজকের সমাজে নামকে জাঁকিয়ে তোলার ক্ষেত্রে মহৎ কর্মের চেয়ে বিতর্কিত কর্মকাণ্ডই অধিক মাত্রায় অনুসৃত হচ্ছে। ব্যক্তির ধারাবাহিক নেতিবাচক কর্মকাণ্ড ব্যক্তির পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট এলাকাও বিশদ পরিসরে পরিচিতি পায়। অর্থাৎ ব্যক্তির সঙ্গে এলাকারও ‘নাম ফাটে’। নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার বসুরহাট তার সর্বশেষ উদাহরণ। 

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের অনুজ ও বসুরহাট পৌরসভার চেয়ারম্যান আবদুল কাদের মির্জার বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের পরম্পরা বসুরহাটকে ইতিমধ্যে দেশজোড়া পরিচিতি দিয়েছে। কয়েক বছর ধরে তাঁর বহুবিধ তৎপরতায় অনেকটা নিয়মিতভাবে বসুরহাট সংবাদ শিরোনামে জায়গা করে নিয়েছে।

কাদের মির্জার অসংখ্য কর্মকাণ্ডের একটি হলো, তিনি ২০২১ সালের অক্টোবরে এক ব্যবসায়ীকে তুলে নিয়ে প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা পৌরসভা কার্যালয়ে আটকে রেখেছিলেন। এবার তাঁকে এক ধাপ পেছনে ফেলে দিয়ে তাঁর আরেক ভাই শাহদাত হোসেন স্থানীয় যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা-কর্মীদের নিয়ে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিউবো) এক প্রকৌশলীকে আটকে মারধর করে মাথা ন্যাড়া করে দিয়েছেন। এ কথা তিনি সদর্পে স্বীকারও করেছেন। 

সাইফুল ইসলাম নামের ওই প্রকৌশলী অনুমোদনহীন বিদ্যুৎ লাইন নির্মাণে বাধা দিয়েছিলেন। সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, বিউবোর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের লোকজন তাঁদের নির্ধারিত কাজ না করে বসুরহাট পৌরসভার ৮ নম্বর ওয়ার্ডে একটি এলটি বিদ্যুৎ লাইন বসাচ্ছিলেন। ওই লাইন নির্মাণের কোনো দাপ্তরিক অনুমোদন ছিল না। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার নির্দেশে সাইফুল ইসলাম সে কাজে বাধা দেন। এরপরই তাঁর বিরুদ্ধে ঘুষ চাওয়ার অভিযোগ তুলে তাঁকে দুই দফা পেটানো হয় এবং একপর্যায়ে মাথা ন্যাড়া করে দেওয়া হয়। 

আহত ও মুণ্ডিত মস্তকের ওই প্রকৌশলী লজ্জায় হাসপাতালেও ভর্তি হননি। এ ঘটনায় মামলা হয়নি। বিদ্যুৎ বিভাগও কোনো পদক্ষেপ নেয়নি; নেওয়া হবে এমন লক্ষণও দৃশ্যমান নয়। একজন সরকারি কর্মকর্তার সঙ্গে এহেন আচরণের পর শাহদাত হোসেনের নির্বিকার স্বীকারোক্তি ও ঔদ্ধত্যের নেপথ্য যে জবাবদিহিহীন প্রবল রাজনৈতিক প্রভাব কাজ করেছে, তা লেখা বাহুল্য। 

শাহদাত হোসেন তাৎক্ষণিক রাগের মাথায় এই কাজ করেছেন—এমনটি মনে করা কঠিন। বরং তিনি কাউকে পীড়ন-নির্যাতন করলে প্রশাসনও তাঁকে কিছু করার সামর্থ্য রাখে না—এই গুরুতর বার্তা সম্ভবত তিনি ঠান্ডা মাথায় জনমনে দিতে চেয়েছেন। এই ঘটনা আইনের শাসনের অনুপস্থিতিকে এতটাই নির্দেশ করে যে তা জনমনে ক্ষোভের সঞ্চার করে। সেই ক্ষোভ প্রশমনে দোষী ব্যক্তিদের সত্বর ধরা হোক।