সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় আবার চালু হোক

সম্পাদকীয়

ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠা আমাদের অহংকার ও গৌরবের। বাংলা ভাষার অধিকার প্রশ্নে বায়ান্নে তরুণেরা রক্ত দিলেও সেখানে বিশ্বের সব ভাষাভাষী মানুষের মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার চেতনাও ছিল নিহিত।

দুঃখজনক হচ্ছে, ভাষা আন্দোলনের ৭০ বছর পরও সর্বস্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহার ও মর্যাদা রক্ষায় আমাদের নানা সংকট ও প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করতে হচ্ছে। সেখানে এ অঞ্চলের অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর মানুষের ভাষার কী হাল, সেদিকে আমাদের নজর নেই বললেই চলে।

ম্রো জনগোষ্ঠীর বিলুপ্তপ্রায় ভাষা রেংমিটচা আর আটজন মানুষ মারা গেলে পুরোপুরি হারিয়ে যাবে। এমনকি বন্ধ হয়ে গেছে সমতলের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী সাঁওতালদের ভাষার প্রথম স্কুলও। বিষয়টি খুবই হতাশাজনক।

সাঁওতালেরা এ অঞ্চলের অন্যতম আদি জাতিগোষ্ঠী। দিন দিন তাদের অস্তিত্ব সংকুচিত হয়ে পড়ছে। ছোট হয়ে আসছে তাদের ভূমি ও জমি। ২৩ বছর আগে ১৯৯৯ সালে সাঁওতালদের ভাষায় দেশের প্রথম স্কুল প্রতিষ্ঠা হয়েছিল রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার বর্ষাপাড়া গ্রামে।

নিজেদের মাতৃভাষায় পড়াশোনা করত সাঁওতাল শিশুরা। পাঠশালার অবকাঠামো ঠিকই আছে, কিন্তু বন্ধ হয়ে গেছে পাঠদান। সেই পাঠশালার শিক্ষক পরী টুডুর নিঃসঙ্গ জীবন কাটছে। মানসিকভাবে অসুস্থও তিনি।

প্রথম আলোর প্রতিবেদন জানাচ্ছে, জাতীয় আদিবাসী পরিষদের গ্রামীণ ট্রাস্ট সাঁওতাল ভাষার স্কুলটির পরিচালনায় ছিল। তার আগে গ্রামীণ ট্রাস্টের এ প্রকল্পের অধীনে তৈরি করা হয় সাঁওতাল ভাষার বই। সেটির প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন রাজশাহী সদর আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য ফজলে হোসেন বাদশাও।

এই স্কুল প্রতিষ্ঠার পর মাতৃভাষায় পড়ার সুযোগ তৈরি হয়েছিল সাঁওতাল শিশুদের। তাদের ঝরে পড়ার হারও কমে গিয়েছিল। দেড় যুগ আগে এ পাঠশালার খবর উঠে আসে প্রথম আলোসহ দেশ–বিদেশের সংবাদমাধ্যমে। সে সময় স্কুলটিতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল শতাধিক। ২০০৫ সালে এসে এসব শিক্ষার্থীর কলরব থেমে যায়। বন্ধ হয়ে যায় স্কুলটি।

শুরুতে গ্রামীণ ট্রাস্টের অর্থায়নে স্কুলটি চললেও পরে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র এর দায়িত্ব নিয়েছিল। তারাও পরে অর্থায়ন বন্ধ করে দিলে পরী টুডু আর পাঠশালাটি চালাতে পারেননি। জীবনের নানা ঘাত–প্রতিঘাত সহ্য করে তিনি আজ মানবেতর জীবনযাপন করছেন।

তাঁর পক্ষেও সম্ভব নয় স্কুলটিকে আবার চালু করা। দেশে মাতৃভাষা চর্চা ও গবেষণার জন্য ইনস্টিটিউট ও নানা কর্মসূচি আছে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে সাঁওতাল ভাষার স্কুলটি আবার চালু করা হোক। এ দেশের মানুষ নিজের ভাষার অধিকার জন্য প্রাণ দিল, সেই দেশেই আরেক জাতিগোষ্ঠীর মানুষ মাতৃভাষায় পড়াশোনা করতে পারবে না, সেটি কী করে হয়? এটি তো জাতি হিসেবে আমাদের জন্য লজ্জার। রাষ্ট্রের জন্যও ব্যর্থতা।