কর্মী বসিয়ে বেতন দেওয়া বন্ধ করুন

সম্পাদকীয়

দেশে-বিদেশে পাটজাত পণ্যের ব্যাপক চাহিদা থাকার পরও পাটশিল্প দীর্ঘদিন কেন উপেক্ষিত এবং তার পরিচালন নীতি কেন অস্বচ্ছতায় আবৃত থেকেছে, তা নিয়ে ‘দীর্ঘ দিবস-দীর্ঘ রজনী’ বহু সভা-সেমিনার হয়েছে। আর অন্যদিকে সেই সব সভাস্থলের বাইরে পাটকলগুলো কোমায় থাকা রোগীর মতো ধুঁকেছে।

অবশেষে ‘জীবনযন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিতে’ ২০২০ সালের ১ জুলাই এক সরকারি আদেশে ‘কোমাচ্ছন্ন’ পাটশিল্পের লাইফ সাপোর্ট খুলে নেওয়া হয়েছিল। ওই দিন বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশনের (বিজেএমসি) ২৫টি পাটকল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। এতে এক দিনেই অর্ধলক্ষাধিক শ্রমিক চাকরি হারিয়েছিলেন।

এর পর থেকে বিজেএমসির আর কোনো কারখানা চালু হয়নি। অর্থাৎ ২০২০ সালের জুলাই মাসের ১ তারিখে পাটশিল্পের আনুষ্ঠানিক মৃত্যু হয়েছিল।

এখন মনে হচ্ছে পাটশিল্পের ‘অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া’র বাকি আছে। কারণ, কারখানা বন্ধ হয়ে গেলেও এখনো ২ হাজার ৫১৭ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী আছেন। গল্পগুজব করা ছাড়া হাতে কোনো কাজকর্ম না থাকায় সেই ধারাবাহিক গল্পসল্পের মজুরি বাবদ মাসের পর মাস তাঁদের বেতন দেওয়া হচ্ছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে শুধু বেতন হিসেবেই সরকারের তহবিল থেকে তাঁদের পেছনে ১৪০ কোটি ৫০ লাখ টাকা খরচ হয়েছে।

এই খরচ যে মূলতই ‘অপখরচ’ ও অপব্যয় এবং নৈতিকভাবে অগ্রহণযোগ্য, তা সরকারের কাছে স্বীকার্য হওয়া দরকার। যেখানে পাটের তৈরি চট, বস্তা, নানা ধরনের ব্যাগ, পার্টস, জুতা, পুতুল, ম্যাট, শতরঞ্জি, শিকা, পাপোশ, সুতা, ল্যাম্পশেড, টুপি, চাবির রিং, মানিব্যাগ, ক্যালেন্ডার, কম্বল, পাট ও প্লাস্টিকের সমন্বয়ে তৈরি ফাইবার প্লাসসহ বিভিন্ন গৃহস্থালি পণ্যের চাহিদা বিশ্ববাজারে বাড়ছেই; পাটকল বন্ধ রেখে বিপুলসংখ্যক জনবলের এই অপচয় চলছে দিনের পর দিন।

এ অবস্থা থেকে দ্রুত বের হয়ে আসা দরকার। জনবলের যথার্থ ব্যবহার নিশ্চিত করা খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে। বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে অবশ্য বলা হয়েছে, বিজেএমসির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আত্তীকরণের চিন্তাভাবনা আছে। বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। তবে সেই প্রক্রিয়ার গতি খুবই মন্থর। কারণ, কর্মকর্তারা জানাচ্ছেন, আত্তীকরণের জন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে একটি আইন হবে। এরপর পরের প্রক্রিয়া চলবে।

লক্ষণীয় বিষয় হলো, কারখানা বন্ধ ও শ্রমিক ছাঁটাইয়ের পরও লোকসান দিচ্ছে বিজেএমসি। গত অর্থবছরে বিজেএমসির লোকসান ২৬০ কোটি টাকার বেশি। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন, সম্পত্তি মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ, জ্বালানি-বিদ্যুৎ, অপচয় ইত্যাদি খাতে এই লোকসান হয়েছে। আর ২০২০-২১ অর্থবছরে বিজেএমসির লোকসান হয়েছিল প্রায় ৩৭৩ কোটি টাকা।

প্রথম আলোর প্রতিবেদনে এ-সংক্রান্ত যে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে, তাতে এটি স্পষ্ট যে পাট খাত ব্যবস্থাপনায় খামতি রয়েছে। বিজেএমসি এখন বন্ধ পাটকল ভাড়া দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, কিন্তু ভাড়াটে পাওয়া যাচ্ছে না। এখন পর্যন্ত বিজেএমসি মাত্র ছয়টি পাটকল ভাড়া দিয়েছে। ভাড়া ছয় পাটকলের মধ্যে চারটি চালু করা হয়েছে। আর যঁাদের কাছে এসব পাটকল ভাড়া দেওয়া হয়েছে, তঁাদের কেউই পাট ব্যবসায় সম্পৃক্ত নন।

সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো, বন্ধ পাটকলের যন্ত্রপাতি নষ্ট হচ্ছে। ভবনগুলোতে ময়লার স্তূপ, গাছ-লতাপাতায় ছেয়ে যাচ্ছে। অনেক পাটকল এখন জঙ্গল। এসব কারখানার সম্পত্তি রক্ষাই বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে। বিজেএমসির মোট জমির পরিমাণ ১ হাজার ৫১৭ একর। এই বিপুল পরিমাণ সম্পদ যে বেদখল হওয়ার ঝুঁকিতে আছে, তা স্পষ্ট। কারণ, ইতিমধ্যেই কারখানাগুলোর অনেক জমি বেদখল হয়েছে বলে খবর বেরিয়েছে।

এ অবস্থায় কর্তব্য কারও অজানা নয়, ঘাটতি শুধু সদিচ্ছায়। সরকারের সদিচ্ছার উদয় হোক।