দায়ীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিন

পঞ্চগড়ে করতোয়া নদীতে নৌকাডুবিতে প্রাণহানির ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে এটা স্পষ্ট যে এখানে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের চরম অবহেলা, অদক্ষতা ও দায়িত্বহীনতা ছিল। প্রথম আলোর প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, তদন্ত কমিটি আটটি কারণ খুঁজে বের করার পাশাপাশি দুর্ঘটনা রোধে পাঁচটি সুপারিশ করেছে।

উল্লেখ্য, গত ২৫ সেপ্টেম্বর দুপুরে পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার মাড়েয়া বাজারের পাশে করতোয়া নদীর আউলিয়ার ঘাট থেকে শতাধিক মানুষ নিয়ে শ্যালো ইঞ্জিনচালিত একটি নৌকা বড়শশী ইউনিয়নের বদেশ্বরী মন্দিরের দিকে যাচ্ছিল। যাত্রীদের অধিকাংশই বদেশ্বরী মন্দিরে মহালয়ার অনুষ্ঠানে যোগ দিতে যাচ্ছিলেন। ঘাট থেকে কিছু দূর যাওয়ার পর নৌকাটি ডুবে যায়। এতে ৬৯টি লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। নিখোঁজ রয়েছেন তিনজন।

জেলা পরিষদ থেকে দরপত্রের মাধ্যমে করতোয়া নদীর আউলিয়ার ঘাট ইজারা নেন আবদুল জব্বার নামের এক ব্যক্তি। পরে তিনি এর সঙ্গে আরও কয়েকজনকে যুক্ত করেন, যা ছিল ইজারার শর্তের পরিপন্থী। ইজারাদার যাঁদের মাঝি হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন, তাঁরা ছিলেন অনভিজ্ঞ ও অদক্ষ। মহালয়া ও দুর্গাপূজা উপলক্ষে পারাপার হওয়া মানুষের সংখ্যা অনেক বেশি থাকায় ছয়টি নৌকার ব্যবস্থা করার কথা ছিল; ইজারাদার করেছেন মাত্র দুটি। স্বাভাবিকভাবে নৌকায় ধারণক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি যাত্রী উঠেছেন। স্থানীয় প্রশাসন ও জেলা পরিষদও তাদের দায়িত্ব পালন করেনি। একটি ধর্মীয় উৎসবকে ঘিরে তাদের যথেষ্ট প্রস্তুতি ছিল না, সেটি বোঝা যায়। যে ঘাট থেকে বছরে সাড়ে ৯ লাখ টাকা রাজস্ব তুলে নেয় সরকার, সেই ঘাটের উন্নয়ন ও রক্ষণাবেক্ষণে তাদের কিছুই করণীয় নেই?

অন্যদিকে নৌকার মাঝিদের অবহেলা ছিল অমার্জনীয়। পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের লোকজন নিষেধ করার পরও তাঁরা নৌকায় অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাই করেছেন অধিক মুনাফার আশায়। ৪৭ ফুট দীর্ঘ ও সাড়ে ১০ ফুট প্রস্থের নৌকাটির ধারণক্ষমতা ছিল ৪০ থেকে ৪৫ জনের। ওঠানো হয়েছিল ১০৫ জনকে। এদের বেশির ভাগ ছিল নারী ও শিশু। এ ছাড়া ইঞ্জিনও ছিল ত্রুটিপূর্ণ, মাঝনদীতে একবার বিকল হয়ে যায়। তাই এটা দুর্ঘটনা হলেও মানবসৃষ্ট, তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনেও যা উঠে এসেছে।

অদক্ষ ও অনভিজ্ঞ লোক দিয়ে নদীতে লোক পারাপারের অর্থ হলো যাত্রীদের মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া। যে ঘাট থেকে সরকার লাখ লাখ টাকা রাজস্ব আয় করে, সেই ঘাটে যাত্রী সুরক্ষা ও নিরাপত্তার ক্ষেত্রে এত অবহেলা কেন? যে নদীতে বছরের অর্ধেক সময় নৌকাই চলে না, সেখানে নৌকাডুবিতে এতগুলো মানুষের প্রাণহানির ঘটনা মেনে নেওয়া যায় না। নৌকাডুবির পর স্থানীয় বাসিন্দারা যেভাবে উদ্ধারকাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন, তা অনুসরণীয়। সরকার থেকে শুরু করে রাজনৈতিক দল ও বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনও নিহতদের পরিবারের সহায়তায় এগিয়ে এসেছে। তাদের এ উদ্যোগ আয়োজনকে স্বাগত জানাই। একই সঙ্গে এ কথাও বলব, দুর্ঘটনার পরের সহায়তার চেয়ে যাতে দুর্ঘটনা না ঘটে, সে বিষয়েও যাত্রীসহ সবাইকে সচেতন থাকতে হবে।

তদন্ত কমিটি পঞ্চগড় জেলা প্রশাসকের কাছে প্রতিবেদন জমা দিলেও তা প্রকাশ করা হয়নি। অতীতেও দেখা গেছে, তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন ফাইলবন্দী থাকে। তদন্ত কমিটির অনুসন্ধান ও সুপারিশ যদি জনসমক্ষে প্রকাশই না করা হবে, তাহলে এত উদ্যোগ-আয়োজন কেন? যাঁদের অবহেলা, অদক্ষতা ও উদাসীনতার কারণে করতোয়ায় নৌকা ডুবে এতগুলো মানুষ মারা গেল, তঁাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতেই হবে।