বরিশাল নগরীর উপকণ্ঠে কীর্তনখোলার ওপারে কাউয়ার চরে অবস্থিত ‘হিরণ নগর’। নামের মধ্যে আভিজাত্য থাকলেও বাস্তব চিত্রটি চরম অমানবিক। ২০১২ সালে যখন ভাটারখাল বস্তির বাসিন্দাদের এখানে পুনর্বাসন করা হয়েছিল, তখন আশা ছিল এটি একটি আদর্শ আবাসন হবে। কিন্তু এক যুগ পর দেখা যাচ্ছে, নগরের সুবিধা তো দূরে থাক, মানুষের ন্যূনতম বেঁচে থাকার নিশ্চয়তাটুকুও সেখানে নেই।
হিরণ নগরের প্রতিটি খুপরিঘরের ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে আছে অভাব আর দীর্ঘশ্বাসের গল্প। ঘরগুলোর বেড়া কোথাও তালি দেওয়া টিন, কোথাও পুরোনো সিমেন্টের বস্তা বা পচা চট। জোয়ারের পানি বাড়লে ঘর ভেসে যায়, বৃষ্টি হলে চাল চুইয়ে পানি পড়ে। চার হাজার মানুষের এই জনপদে নেই নিরাপদ পানি, নেই স্বাস্থ্যসম্মত পয়োনিষ্কাশন। একসময় যে পরিবারকে ২ শতাংশ জমি দেওয়া হয়েছিল, সদস্য বেড়ে সেই পরিবার এখন তিনটিতে রূপ নিলেও জমির পরিধি বাড়েনি। ফলে মানুষ আজ সেখানে আক্ষরিক অর্থেই ভীষণ গাদাগাদি করে বসবাস করছে।
কোস্টাল ডেভেলপমেন্ট পার্টনারশিপের (সিডিপি) ২০২২ সালের গবেষণা তথ্য বলছে, এখানকার প্রায় ২৯ শতাংশ মানুষ নিয়মিত তিন বেলা খাবার জোগাড় করতে পারেন না। ১৭ শতাংশের বেশি মানুষ নিরক্ষর এবং ৯১ শতাংশের নেই কোনো আয়বর্ধক কারিগরি দক্ষতা। এই পরিসংখ্যানে স্পষ্ট আমাদের উন্নয়ন–দর্শনে কতটা গলদ আছে। যাঁরা জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার কিংবা নদীভাঙনে ভিটেমাটি হারিয়ে এখানে আশ্রয় নিয়েছেন, তাঁদের জন্য রাষ্ট্র কেবল একখণ্ড জমি দিয়েই দায় সেরেছে। কিন্তু তাঁদের কর্মসংস্থান, শিক্ষা ও নিরাপত্তার বিষয়টি পুরোপুরি উপেক্ষিত থেকে গেছে।
সবচেয়ে আশঙ্কাজনক বিষয় হলো—শিক্ষা, কর্মসংস্থানের অভাব এবং সুস্থ বিনোদনের সুযোগ না থাকায় এই কলোনির যুবসমাজ বড় পরিসরে মাদকাসক্তিতে জড়িয়ে পড়ছে। হিরণ নগরের এই অমানবিক পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে বরিশাল সিটি করপোরেশন ও জেলা প্রশাসনকে যৌথ উদ্যোগ নিতে হবে। কেবল ‘পুনর্বাসন’ করলেই দায়িত্ব শেষ হয় না, সেই পুনর্বাসিত এলাকায় নাগরিক জীবনের মৌলিক অবকাঠামো নিশ্চিত করা জরুরি। নারীদের জন্য কুটিরশিল্প বা হস্তশিল্পের প্রশিক্ষণ, যুবকদের জন্য কারিগরি শিক্ষা এবং এলাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিয়মিত তদারকি নিশ্চিত করা সময়ের দাবি। একই সঙ্গে নিচু এলাকা হওয়ায় টেকসই বাঁধ নির্মাণ ও নিরাপদ পানির সংকট নিরসনে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে।
আমরা মনে করি, হিরণ নগরকে তার নামের সার্থকতা ফিরিয়ে দিতে হলে কেবল কাগজ-কলমে একে ‘নগর’ বললে চলবে না; একে বাসযোগ্য করার রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সদিচ্ছা দেখাতে হবে। অন্যথায় নগরের এই বিচ্ছিন্ন জনপদটি কেবল অপরাধ আর দারিদ্র্যের প্রজননক্ষেত্র হিসেবেই ইতিহাসে টিকে থাকবে।