বাংলাদেশে জনসংখ্যার বৃহত্তর অংশ অর্থনৈতিকভাবে খুবই ভঙ্গুর অবস্থায় আছে। আমরা যাঁদের বিত্তহীন বলি, যাঁদের সহায়-সম্পদ তেমন নেই, তাঁরা নিয়ত দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে থাকেন। কিন্তু মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষকে আরেক ধরনের সংগ্রাম করে টিকে থাকতে হয়।
স্বাভাবিক অবস্থায় একরকম তাঁদের চলে যায়। সমস্যা হয় যখন দুর্যোগ-দুর্বিপাক আসে। সেটি হোক করোনার মহামারি কিংবা প্রাকৃতিক দুর্যোগ। অবস্থানগত কারণেই পরিস্থিতি মোকাবিলার সামর্থ্য তাঁদের কম। আবার তাঁরা অন্যের কাছে সহায়তার জন্য হাত পাততেও পারেন না।
এ অবস্থায় মধ্যবিত্ত মানুষের একটি অংশেরও সামাজিক সুরক্ষা ও সহায়তা যে জরুরি, সে কথাই উঠে এসেছে ২৭ অক্টোবর সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং আয়োজিত এক ওয়েবিনারে। আলোচনার বিষয় ছিল ‘সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী: বাংলাদেশ কোথায় দাঁড়িয়ে’। এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে এই মুহূর্তে বাংলাদেশ খুব ভালো অবস্থায় নেই।
নিত্যপণ্যের দাম হু হু করে বাড়ছে। জ্বালানির ঘাটতি জনজীবনের স্বস্তি কেড়ে নিয়েছে। ওয়েবিনারে উত্থাপিত প্রবন্ধে সানেমের চেয়ারম্যান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক বজলুল হক খন্দকার বলেছেন, দেশের প্রায় ২৫ শতাংশ মানুষ অরক্ষিত। তাঁরা যেকোনো ধাক্কায় হঠাৎ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যেতে পারেন, কোভিডের সময় যা দেখা গেল। সে জন্য সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় ৫৫ থেকে ৬০ শতাংশ মানুষকে নিয়ে আসা উচিত।
তবে তিনি এ কথাও স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে সরকারের পক্ষে সবাইকে সহায়তা করা সম্ভব না–ও হতে পারে। সে ক্ষেত্রে বেসরকারি খাতও এগিয়ে আসতে পারে। বিপন্ন মানুষকে সহায়তার দুটি উপায় হতে পারে। সহজ শর্তে ও স্বল্প সুদে ঋণ ও আর্থিক সহায়তা। প্রকৃত দরিদ্র ও ক্ষতিগ্রস্ত মানুষেরই পাওয়ার কথা।
কিন্তু ওয়েবিনারে উত্থাপিত প্রবন্ধে যেসব তথ্য উঠে এসেছে, তা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। যেখানে নবজাতক, শিশু ও বৃদ্ধদের বেশি সহায়তা প্রয়োজন, সেখানে তাঁরাই কম পাচ্ছেন আর কর্মক্ষম মানুষ বেশি পাচ্ছেন। গ্রামাঞ্চলে দারিদ্র্যের হার ২৬ দশমিক ৪ এবং সহায়তা পাচ্ছেন ৩৫ দশমিক ৭ শতাংশ। অথচ শহরাঞ্চলে দারিদ্র্যের হার ১৮ দশমিক ৯ এবং সহায়তা পাচ্ছেন ১০ দশমিক ৯ শতাংশ।
এর চেয়েও উৎকণ্ঠার বিষয় হলো গড়ে ৭১ শতাংশ ভুল মানুষের সহায়তা পাওয়া। গ্রামাঞ্চলে এই ভুল মানুষের সংখ্যা ৮৪ শতাংশ এবং শহরাঞ্চলে ৬৭ শতাংশ। সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির অনিয়ম, দুর্নীতি নিয়ে গণমাধ্যমে নিয়মিতই খবর প্রকাশিত হয়। এমনকি করোনাকালে সরকার যে ৫০ লাখ পরিবারকে এককালীন সহায়তা দিয়েছে, তাতে অনেক নয়ছয় হয়েছে। দোতলা বাড়ির মালিককেও খয়রাতি সাহায্য দেওয়া হয়েছে। আবার সহায়তা পাওয়ার ক্ষেত্রে গ্রাম ও শহরের বৈষম্যটাও চোখে পড়ার মতো।
৩৫ শতাংশ মানুষ সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির সুবিধা পাচ্ছে বলে দাবি করা হয়। কিন্তু সেই সুবিধা কতটা সুরক্ষা দিচ্ছে, তা-ও দেখার বিষয়। জনপ্রতি ৫৯৫ টাকা গড় বরাদ্দ দিয়ে কারও জীবনমান বাড়ানোর চিন্তা যদি সরকার করে থাকে, সেটা আকাশকুসুম কল্পনাই বটে।
বাংলাদেশে জিডিপির বিপরীতে রাজস্ব আয়ের অনুপাত হতাশাজনকভাবে কম। ফলে সামাজিক সুরক্ষার আওতা কার্যকরভাবে বাড়ানো যায় না। রাজস্ব বাড়িয়ে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি সংস্কার প্রয়োজন। সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিতে মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্তকে অন্তর্ভুক্ত করার পাশাপাশি ভুল মানুষের কাছে সেই সহায়তা যাতে না যায়, তা নিশ্চিত করাও জরুরি।