দুর্গম পাহাড়ের বাসিন্দাদের অভিবাদন

পার্বত্য চট্টগ্রামের দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় স্বাস্থ্যসুবিধা ও শিক্ষার অভাবের কথা আমাদের অজানা নয়। সেখানে চাকচিক্যময় ও বিলাসবহুল পর্যটনকেন্দ্র গড়ে উঠেছে ঠিকই, কিন্তু ছাত্রাবাসের অভাবে দূরদূরান্তের শিক্ষার্থীরা অনায়াসে ঝরে পড়ে যায়। এমন করুণ বাস্তবতায় বান্দরবানে পাহাড়ি বাসিন্দাদের একটি সমিতি মাটির ব্যাংকে টাকা জমিয়ে ছেলেমেয়েদের জন্য দুটি আলাদা ছাত্রাবাস করেছে। নিঃসন্দেহে এটি একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ। 

প্রথম আলোর একটি প্রতিবেদন জানাচ্ছে, বান্দরবান সদর উপজেলার টঙ্কাবতী ইউনিয়নের চাক্কোইপাড়া এলাকার ব্রিকফিল্ড বাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশে এই ছাত্রাবাস ও ছাত্রীনিবাস গড়ে তোলা হয়েছে। এই দুই আবাসিক হলের নাম রাখা হয়েছে ‘আরোং আনৈই’, যার অর্থ ‘অগ্রগতির আলো’। ছাত্রাবাসটিতে ৫০ জন এবং ছাত্রীনিবাসে ২০ জন ম্রো শিশু রয়েছে। তারা সবাই সেখানে থেকেই পড়ছে পাশের ব্রিকফিল্ড বাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে।

ম্রো ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্যে খুঁটির ওপর মাচাং দিয়ে ছাত্র ও ছাত্রীনিবাস দুটি নির্মাণ করা হয়েছে। চারপাশে বাঁশের নিখুঁত বেড়া, ওপরে টিনের ছাউনি। সামনে রয়েছে খোলা বারান্দা। বারান্দায় দাঁড়িয়ে শিক্ষার্থীরা খোলা হাওয়া উপভোগ করতে পারে। ভেতরে একটি কক্ষে সবাই পড়াশোনা করে ও বিছানা পেতে ঘুমায়। শিক্ষার্থীরা মিয়ানমার সীমান্তবর্তী থানচির লেইক্রী, বড়মদক; আলীকদমের কুরুকপাতা ও রুমার নাইতিংয়ে দুর্গম এলাকার।

এ দুই আবাসিক নিবাস গড়ে তুলেছে পাহাড়ি জাতিগোষ্ঠীর একটি সমিতি, যার নাম ক্রংসের ব্যাংকভু। বাংলায় যার অর্থ মাটির ব্যাংক সমিতি। সমিতিটিতে সদস্যসংখ্যা ছয় শতাধিক। সদস্যরা বেশির ভাগই ম্রো জাতিগোষ্ঠীর। তাঁরা প্রত্যেকেই ঘরে মাটির ব্যাংক রাখেন। যখন যতটুকু সম্ভব, সেখানে টাকা জমান। উদ্দেশ্য, সমাজের জন্য, বিশেষ করে শিক্ষার জন্য কিছু করা। ১০ বছর ধরে এসব মাটির ব্যাংকে জমানো ২০ লাখ টাকা দিয়ে এ দুই নিবাস গড়ে তুলেছেন তাঁরা। এই সমিতি আরেকটি তাৎপর্যপূর্ণ কাজ করে যাচ্ছে, জাতিগোষ্ঠীর শিশুদের নিজ ধর্ম, মাতৃভাষা ও বাংলা শিক্ষার পৃষ্ঠপোষকতা করছে। এ দেশের প্রতিটি জাতিগোষ্ঠীর শিশুরা মাতৃভাষা শিখতে পারবে, লিখতে ও পড়তে পারবে—এটি তাদের নাগরিক অধিকারেরই অংশ। আরোং আনৈই সমিতির এমন কার্যক্রম সত্যি প্রশংসনীয়।

সমিতির সদস্য রিংয়ং ম্রো বলেন, আরোং আনৈইর শিক্ষার্থীরা দিনে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় এবং ছাত্রাবাসে বাংলা ও মাতৃভাষায় পড়াশোনা করবে। ম্রো ভাষার আবাসিক শিক্ষকেরা মাতৃভাষায় পাঠদান করবেন। তিনি বলেন, সমিতির সিদ্ধান্ত হলো কেবল দুর্গম এবং বিদ্যালয় নেই, এমন এলাকার শিশুদের ছাত্রাবাস ও ছাত্রীনিবাসে রাখা হবে, যাতে তারা শিক্ষাবঞ্চিত না হয়। 

সমিতি বা সমবায়ের মাধ্যমে একটি জাতি শিক্ষায় কীভাবে এগিয়ে এসেছে, তার একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ বলতে হয় আরোং আনৈই নিবাসকে। আমরা ক্রংসের ব্যাংকভু সমিতি ও এর সব সদস্যকে অভিবাদন জানাই।