নাগরিক সমাজ, রাজনৈতিক দল ও পুলিশ সদস্যদের দাবি উপেক্ষা করে নামমাত্র ক্ষমতা দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার পুলিশ কমিশন অধ্যাদেশের যে অনুমোদন দিয়েছে, সেটা চূড়ান্ত রকমের হতাশাজনক। স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠনের বদলে সুপারিশ-পরামর্শ প্রদানের ক্ষমতাসম্পন্ন যে কমিশন করা হচ্ছে, তাতে পুলিশকে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিকভাবে ব্যবহারের সুযোগ পুরোদমেই থেকে যাচ্ছে। অভ্যুত্থানের পর পুলিশকে জনবান্ধব বাহিনীতে রূপান্তরের যে সুযোগ তৈরি হয়েছিল, আমলাতন্ত্রের চাপে সরকার তা থেকে পিছু হটেছে বলেই আমরা মনে করি। সরকারের এই পদক্ষেপ চব্বিশের গণ–অভ্যুত্থানের জন-আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
পুলিশকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার কমবেশি সব সরকার করলেও হাসিনা সরকারের আমলে তা চূড়ান্ত রূপ পেয়েছিল। বিরোধীদের দমন, মামলা-হামলা, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম, ডিজিটাল নজরদারি, ভয়ের সংস্কৃতি তৈরিসহ নাগরিক নিপীড়নের রাজনৈতিক অস্ত্র করা হয়েছিল পুলিশকে। জাতিসংঘ মানবাধিকার দপ্তরের প্রতিবেদনে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে, চব্বিশের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানকালে যে হতাহতের ঘটনা ঘটেছে, তার বেশির ভাগই ঘটেছে পুলিশের গুলিতে।
পুলিশের বিরুদ্ধে যে তীব্র জনরোষ তৈরি হয়েছিল, তাতে আক্রান্ত হয়েছিল দেশের অনেক থানা, ফাঁড়ি। ফলে পুলিশি ব্যবস্থাটাই ভেঙে পড়েছিল। এর পরিপ্রেক্ষিতে নাগরিক সমাজ, রাজনৈতিক দল এবং খোদ পুলিশ সদস্যদের মধ্য থেকে পুলিশ সংস্কার এবং রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক প্রভাবমুক্ত স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠনের জোরালো দাবি উঠেছিল। পুলিশের নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে কমিশনের অধীন নিয়ে আসার কথা উঠেছিল।
প্রথম আলোর খবর জানাচ্ছে, বৃহস্পতিবার উপদেষ্টা পরিষদের সভায় পুলিশ কমিশন অধ্যাদেশের যে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে, তাতে স্বাধীন পুলিশ কমিশন হচ্ছে না; বরং কমিশনের কার্যক্রমকে সীমিত ও সুপারিশকেন্দ্রিক করা হয়েছে; অর্থাৎ কমিশন মানবাধিকার, প্রশিক্ষণসহ নানা বিষয়ে সুপারিশ ও পরামর্শ দেবে। সমস্যাজনক বিষয় হচ্ছে কমিশনের এসব সুপারিশ-পরামর্শ মানার ক্ষেত্রে পুলিশের কোনো বাধ্যবাধকতা থাকবে না। যাত্রাপালায় বিবেকের ভূমিকার মতো করে পুলিশ কমিশন গঠন করা হলে সেই নখদন্তহীন কমিশন কীভাবে পুলিশকে জনবান্ধব ও গণমুখী বাহিনীতে রূপান্তরিত করতে পারবে?
সরকার ও আমলাতন্ত্রের কাছে পুলিশকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহারের সুযোগ রেখে যত ভালো ও যোগ্য ব্যক্তিদের দিয়ে কমিশন গঠন করা হোক না কেন, বাস্তবে সেটা কোনো ফলপ্রসূ ভূমিকা রাখতে পারবে না। অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ অফিসার কল্যাণ সমিতির সাবেক সভাপতি এম আকবর আলী নতুন করে পুলিশের ওপর হস্তক্ষেপের সুযোগ তৈরি করা হলো বলে যে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন, সেটা যথার্থ বলেই আমরা মনে করি। পুলিশকে আগের মতো চালানোর সব আয়োজন রেখে জনবান্ধব পুলিশের প্রত্যাশা করাটা বাতুলতা ছাড়া আর কী হতে পারে?
অভ্যুত্থানের পর পুলিশ সংস্কারের জোরালো দাবি সমাজের সব অংশ থেকে উঠলে আইন উপদেষ্টার নেতৃত্বে একটি কমিটি পুলিশ কমিশনের খসড়া তৈরি করে। সেই খসড়ায় পুলিশকে খুব সামান্য ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেই খসড়া স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে গেলে সেই ক্ষমতাটুকুও বাদ দেওয়া হয়েছে। শুধু পুলিশ কমিশন নয়, দুর্নীতি দমন কমিশনের সংস্কারের ক্ষেত্রেও আমলাতন্ত্রের এই ভূমিকা দেখা গেছে। প্রশ্ন হচ্ছে, অভ্যুত্থানের ম্যান্ডেট নিয়ে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার জন–আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের বদলে কেন আমলাতন্ত্রের চাপে পথ বিচ্যুত হবে। এমন লোকদেখানো সংস্কার কী অর্থ বহন করতে পারে।