পুকুর খননের আগ্রাসন থামাতেই হবে

সম্পাদকীয়

‘ধান-চালের জেলা’ হিসেবে পরিচিত নওগাঁ দিন দিন তার কৃষি-ঐতিহ্য হারাচ্ছে। কৃষকদের একপ্রকার বাধ্য করে বা জোরপূর্বক ফসলি জমি ইজারা নিয়ে সেখানে পুকুর খনন করে মাছ চাষ করছেন প্রভাবশালীরা। একসময় যেখানে বোরো, আমন ধান, পাট ও শর্ষের মতো অর্থকরী ফসল ফলত, আজ সেখানে কেবলই মাছের চাষ। মাছ চাষও আমাদের খাদ্যের চাহিদা পূরণের জন্য জরুরি। কিন্তু কৃষি ও কৃষককে হুমকির মুখে ফেলে যেভাবে জেলাটিতে মাছ চাষ করা হচ্ছে, তাতে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।

কৃষি দপ্তরের হিসাব অনুসারে, ২০১৪ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত এক দশকে জেলার প্রায় ৪ শতাংশ তিন ফসলি জমি পুকুরের পেটে চলে গেছে। বিশেষত রানীনগর ও আত্রাই উপজেলার মতো কৃষিপ্রধান এলাকায় এই প্রবণতা সবচেয়ে বেশি। প্রভাবশালী মাছচাষিরা কৃষকদের জমির চারপাশে পুকুর খনন করায় উঁচু পাড়ের বহু কৃষকের জমিতে সারা বছরই পানি আটকে থাকছে। ফসল নষ্ট হওয়ায় তাঁরা বাধ্য হচ্ছেন পুকুর খননকারীদের কাছে জমি ইজারা দিতে। কৃষকদের অভিযোগ, স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের (সাবেক সংসদ সদস্যদের) প্রশ্রয়ে এবং প্রশাসনের ‘ম্যানেজ’ করার মাধ্যমে যথেচ্ছভাবে এই পুকুর খনন চলছে। নওগাঁর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) স্বীকার করেছেন, ফসলি জমিতে পুকুর খনন ঠেকাতে সুনির্দিষ্ট কোনো আইন বা নীতিমালা নেই। দুর্বল নজরদারির সুযোগেও রাতারাতি পুকুর খনন হয়ে যায়।

বাণিজ্যিক মাছ চাষের জন্য শত শত কৃষককে ফসল আবাদ থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। অনেক কৃষককে এখন দিনমজুরি করে সংসার চালাতে হচ্ছে। ইজারার টাকা দিয়ে চাল-খড়-সবজি সবই কিনতে হচ্ছে। যে কারণে এক কৃষকের জিজ্ঞাসা, ‘খালি মাছ খ্যায়ে কি আমাগের প্যাট ভরবে?’ বিলে যত্রতত্র পুকুর খোঁড়ার কারণে প্রাকৃতিক পানিপ্রবাহও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, যা জলাবদ্ধতাকে স্থায়ী রূপ দিচ্ছে। সরকারি সংস্থা বিএমডিএর জরিপ অনুযায়ী বরেন্দ্র অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর বিপজ্জনকভাবে নিচে নামছে। উপরন্তু পুকুরের মাছের ঘা সারাতে ব্যবহৃত লবণের কারণে আশপাশের ভূগর্ভস্থ পানিতে লবণাক্ততার মাত্রা দ্বিগুণ থেকে তিন গুণ পর্যন্ত বেড়েছে। আবাদি জমি কমে যাওয়ায় কৃষিশ্রমিকেরা বিশেষত ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষেরা কাজ হারাচ্ছেন, যা তাঁদের শহরমুখী হতে বাধ্য করছে।

মাছের ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণের কথা বলা হলেও তা তিন ফসলি জমিকে বলি দিয়ে সেটা হতে পারে না। প্রস্তাবিত ‘কৃষিজমি সুরক্ষা আইন ২০১৬’ অবিলম্বে পাস করে তিন ফসলি জমিতে পুকুর বা আমবাগানসহ যেকোনো ধরনের রূপান্তর আইনগতভাবে বন্ধ করতে হবে। বিদ্যমান ‘ভূমি অপরাধ প্রতিরোধ ও প্রতিকার আইন ২০২৩’ অনুযায়ী অন্যের জমিতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া এবং স্থানীয় প্রশাসনের নজরদারি বাড়ানো হোক। উন্নয়নের নামে সর্বনাশ বন্ধ করতে হলে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।