অপচয়কারীদের জবাবদিহির আওতায় আনুন

সম্পাদকীয়

বিএনপির আমলে কোন খাতে কত বেশি দুর্নীতি হয়েছে, সেসবের ফিরিস্তি দিতে বর্তমান সরকারের মন্ত্রীরা খুবই উদ্‌গ্রীব থাকেন। বিএনপি সরকার কতটা জনস্বার্থবিরোধী আর তারা কতটা জনস্বার্থ রক্ষায় সদা সচেষ্ট, সেটা প্রমাণ করাই এর উদ্দেশ্য। ২৫ মার্চ প্রথম আলোয় ২১টি ট্রমা সেন্টার সম্পর্কে যে খবর বের হয়েছে, তাতে পূর্বসূরিদের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে উত্তরসূরিদের ফারাক করা কঠিন।

প্রথম আলোর প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, সারা দেশে ২১টি ট্রমা সেন্টার (আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসাকেন্দ্র) নির্মাণ করেছে স্বাস্থ্য বিভাগ। এর ১০টি ২০০৪-০৫ অর্থবছরে ও ১১টি ২০১০ সালে নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এখন ১৬টিতেই কোনো কার্যক্রম নেই। দুটির নির্মাণকাজ চলছে। দুটিতে শুধু বহির্বিভাগ চালু আছে। একটি সংশ্লিষ্ট জেলা হাসপাতালের অর্থোপেডিকস বিভাগ হিসেবে চালু রয়েছে।

মহাসড়কের পাশে ট্রমা সেন্টার নির্মাণ করার উদ্দেশ্য ছিল, দুর্ঘটনা ঘটলে দ্রুত আহত ব্যক্তিদের সেখানে নিয়ে যাওয়া এবং চিকিৎসা দেওয়া, যাতে প্রাণ বাঁচানো সম্ভব হয়। প্রতিটি ট্রমা সেন্টারে সাতজন পরামর্শক চিকিৎসক (কনসালট্যান্ট), তিনজন অর্থোপেডিকস সার্জন, দুজন অ্যানেসথেটিস্ট (অবেদনবিদ), দুজন আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তাসহ মোট ১৪ জন চিকিৎসক, ১০ জন নার্স এবং ফার্মাসিস্ট, রেডিওগ্রাফার, টেকনিশিয়ানসহ ৩৪টি পদ সৃজনের প্রস্তাব করা হয়েছিল। কিন্তু কোনো সেন্টারেই পদ অনুযায়ী জনবল নিয়োগ দেওয়া হয়নি। দেওয়া হয়নি সরঞ্জামও।

জনগণের করের অর্থে কোটি কোটি টাকা খরচ করে এসব ট্রমা সেন্টার প্রতিষ্ঠা করা হলেও সেগুলো জনগণের কোনো কাজে আসছে না। গত নভেম্বর মাসে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক উদ্বোধন করেন শিবচরের দত্তপাড়ায় নির্মিত ইলিয়াস আহমেদ চৌধুরী ট্রমা সেন্টার। কিন্তু সেটি এখনো চালু করা সম্ভব হয়নি লোকবল ও যন্ত্রপাতি না থাকায়।

দেশের প্রায় সব ট্রমা সেন্টারের একই হাল। সেখানে ভবন আছে, আসবাব আছে, কিন্তু নেই চিকিৎসা করার মতো লোকবল ও সরঞ্জাম। বিএনপি আমলের ট্রমা সেন্টারগুলো চালু না হওয়ার পরও আওয়ামী লীগ আমলে নতুন করে ট্রমা সেন্টার নির্মাণ করা হলো কেন? একটাই যুক্তি হতে পারে, ‘সরকারি কা মাল দরিয়া মে ঢাল’। টাকা যেহেতু জনগণের, সেহেতু কোথাও কাউকে হিসাব দিতে হয় না। এই ধারাই চলে আসছে পূর্বাপর সব সরকারের আমলে।

দুই সরকারের আমলে ২১টি ট্রমা সেন্টার নির্মাণের পর এখন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) শেখ দাউদ আদনান প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ট্রমা সেন্টার ধারণাটি বাস্তবসম্মত নয়। তাঁর মতে, পরিকল্পনাগত দুর্বলতার কারণে ট্রমা সেন্টারগুলো কাজে লাগানো যায়নি।

ট্রমা সেন্টার চালানোর মতো জনবল নেই। নতুন করে আর ট্রমা সেন্টার নির্মাণ করা হবে না। বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) মহাসচিব ইহতেশামুল হক চৌধুরী বলেছেন, জবাবদিহির ব্যবস্থা না থাকায় ট্রমা সেন্টারের মতো প্রকল্প নেওয়া হয়েছে।

শুধু ট্রমা সেন্টার নয়, প্রথম আলোয় ২২ নভেম্বরে আরেক খবরে বলা হয়, স্বাস্থ্য খাতে ব্যবহৃত হচ্ছে না, এমন স্থাপনা ২৩৩টি। কোনো স্থাপনায় একটি ভবন, কোনো কোনোটিতে ছয়-সাতটি ভবন রয়েছে।

এর মধ্যে ১০ বা ২০ শয্যার হাসপাতাল যেমন আছে, তেমনি আছে ১০ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট ট্রেনিং স্কুল।

এই হলো আমাদের স্বাস্থ্য খাতের মালিক-মোক্তারদের দায়িত্বশীলতা ও জবাবদিহির নমুনা। স্বাস্থ্য বিভাগের যেসব কর্মকর্তা অবাস্তবকে বাস্তব হিসেবে চালিয়ে দিতে জনগণের করের বিপুল অর্থ খরচ করেছেন, তাঁদের অবশ্যই জবাবদিহির মধ্যে আনতে হবে। গুরুতর অনিয়মকারীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে। অন্যথায় নানা অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প ও ভবনের নামে অপচয় চলতেই থাকবে।