অন্তর্বর্তী সরকারের বিশ্বাসযোগ্যতার সংকট

অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে সন্ত্রাসবিরোধী আইনের যথেচ্ছ ব্যবহার নিয়ে নানা প্রশ্ন ও আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। সম্প্রতি সাংবাদিক আনিস আলমগীরকে যেভাবে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এটি অন্তর্বর্তী সরকারের শাসনপদ্ধতি, মানবাধিকার বিষয়ে তাদের অঙ্গীকার এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ভবিষ্যৎ নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন তুলেছে। স্বৈরাচারী শাসনের অবসানের পর পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি নিয়ে ক্ষমতায় এসেছিল অন্তর্বর্তী সরকার। তাদের আমলেই যদি পুরোনো দমনমূলক পদ্ধতির পুনরাবৃত্তি ঘটে, তবে সেই পরিবর্তনের অর্থ কী—এই প্রশ্ন এড়ানো যায় না।

রোববার আনিস আলমগীরকে কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়াই ডিবি কার্যালয়ে ডেকে নিয়ে যাওয়া, সেখানে রাতভর আটকে রাখা এবং পরদিন একটি সন্ত্রাসবিরোধী মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো—এই পুরো প্রক্রিয়াই ন্যায়বিচারের মৌলিক নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। সোমবার এক বিবৃতিতে এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে সম্পাদক পরিষদ। বিবৃতিতে সংবাদপত্রের সম্পাদকদের এই সংগঠন বলেছে, এ ধরনের আচরণ অতীতের স্বৈরাচারী শাসনামলে সাংবাদিকদের প্রতি রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়নের স্মৃতি উসকে দেয়। 

এ ঘটনা এমন এক পরিপ্রেক্ষিতে ঘটছে, যখন অন্তর্বর্তী সরকার সন্ত্রাসবিরোধী আইনের সংশোধিত সংস্করণকে ক্রমে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে—এমন অভিযোগ উঠেছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের পক্ষ থেকেও। সংস্থাটি বলেছে, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সমর্থক হিসেবে সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের গ্রেপ্তারে এই আইন ব্যবহৃত হচ্ছে। এটি উদ্বেগজনক; কারণ এতে নাগরিক অধিকার ক্ষুণ্ন হচ্ছে এবং আইনটি তার মূল উদ্দেশ্য; অর্থাৎ সন্ত্রাস দমন থেকে সরে এসে মতপ্রকাশ দমনের অস্ত্রে পরিণত হচ্ছে।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচের তথ্য অনুযায়ী, অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে হাজার হাজার মানুষ গ্রেপ্তার হয়েছেন, যাঁদের অনেকের বিরুদ্ধেই শুধু সন্দেহের ভিত্তিতে গুরুতর অভিযোগ আনা হয়েছে। পুলিশি হেফাজতে নির্যাতন, চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত রাখার অভিযোগও পাওয়া গেছে। এসব চিত্র বাংলাদেশের মানুষের কাছে নতুন নয়। শেখ হাসিনার শাসনামলে যেসব নির্যাতন, হয়রানি ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত গ্রেপ্তার দেখা গেছে, বর্তমান পরিস্থিতি সেগুলোর কথাই মনে করিয়ে দিচ্ছে।

এই বাস্তবতা আরও উদ্বেগজনক হয়ে ওঠে, যখন দেখা যায় সরকার কট্টরপন্থী ও সহিংস গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হচ্ছে। উচ্ছৃঙ্খল জনতার হামলায় এ বছর শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে। একদিকে রাষ্ট্র নিজে নাগরিকদের ‘সন্ত্রাসী’ তকমা দিয়ে কারাগারে পাঠাচ্ছে, অন্যদিকে প্রকৃত সহিংসতা ও মবের ঘটনা ন্যায়বিচারের বাইরে থেকে যাচ্ছে। সুশাসন ও নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় এমনটি কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। 

শান্তিপূর্ণ বক্তব্য ও সমাবেশের অধিকার আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মানদণ্ডে সুরক্ষিত। সম্পাদক পরিষদ যেমন সতর্ক করেছে, সন্ত্রাসবিরোধী আইনের এই সংশোধন ও প্রয়োগ গণমাধ্যমের স্বাধীনতাকে সংকুচিত করবে এবং সাংবাদিকদের জন্য ভয় ও আত্মনিয়ন্ত্রণের পরিবেশ তৈরি করবে। অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস যদিও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর বিধিনিষেধের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। কিন্তু সরকারের ঘোষণার চেয়ে বাস্তব আচরণই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আইন যেভাবে প্রয়োগ হচ্ছে, তাতে সেই অস্বীকার বিশ্বাসযোগ্যতা হারাচ্ছে।

জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তরের সঙ্গে তিন বছরের সমঝোতা স্মারক, ঢাকায় মিশন চালু—এসব উদ্যোগ তখনই অর্থবহ হবে, যখন সরকার রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত গ্রেপ্তার বন্ধ করবে এবং আইনের শাসনকে নিরপেক্ষভাবে প্রতিষ্ঠা করবে। না হলে এসব আন্তর্জাতিক অঙ্গীকার কেবল কূটনৈতিক আনুষ্ঠানিকতায় সীমাবদ্ধ থাকবে।

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান দায়িত্ব ছিল একটি ন্যায্য, নিরাপদ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করা। সেই লক্ষ্য অর্জনে আস্থা, সংলাপ ও অধিকার রক্ষাই হওয়া উচিত ছিল প্রধান কাজ। তার বদলে সন্ত্রাসবিরোধী আইনের অপব্যবহার সরকারকেই একটি নৈতিক ও রাজনৈতিক সংকটের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এই সরকার যদি সত্যিই অতীতের থেকে ভিন্ন কিছু করতে চায়, তবে প্রথম শর্তই হলো ভিন্নমত প্রকাশে নাগরিক অধিকারকে সমুন্নত রাখা এবং সন্ত্রাসবিরোধী আইনের অপব্যবহার বন্ধ করা।