দুষ্টচক্রের আঁতাত ভেঙে দিতে হবে

সম্পাদকীয়

রাজধানী ঢাকা থেকে বড় বড় শহরের সঙ্গে যুক্ত সড়কগুলো নির্মাণের দায়িত্ব সড়ক ও জনপথ বিভাগের। এর বাইরে বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের সড়কগুলো নির্মাণ করে থাকে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)। দুটির সঙ্গে তুলনা করলে মনে হবে, ‘প্রদীপের পাশেই অন্ধকার।’ সড়ক ও জনপথ বিভাগের সড়কগুলোর প্রতি সরকারের যতটা নজর আছে, এলজিইডির সড়কগুলোর প্রতি তা নেই। আমাদের কোনো কোনো সড়ক হাইওয়ে এক্সপ্রেসের মর্যাদা পাচ্ছে, আর অন্যদিকে এলজিইডির অধীন বেশির ভাগ সড়ক খানাখন্দে ভরা ও অপ্রশস্ত।

প্রথম আলোয় ৩ সেপ্টেম্বরের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, এলজিইডির অধীনে থাকা গ্রামীণ সড়কের একটি বড় অংশ বেহাল। সংস্থাটির তথ্য বলছে, ২৫ শতাংশের বেশি সড়ক একেবারে ব্যবহারের অনুপযোগী। যদিও গত তিন অর্থবছরে সড়ক রক্ষণাবেক্ষণে রাজস্ব খাত থেকে এলজিইডি ব্যয় করেছে প্রায় ৬ হাজার ৫২৮ কোটি টাকা। এলজিইডির হিসাব অনুযায়ী, ২০২০-২১ ও ২০২১-২২ অর্থবছরে গ্রামীণ সড়ক মেরামতে বরাদ্দ ছিল যথাক্রমে ২ হাজার ৩৩২ কোটি টাকা ও ২ হাজার ৪৩০ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে তিন হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ থাকলেও ইউক্রেন যুদ্ধের অভিঘাত মোকাবিলায় সরকার যেভাবে উন্নয়ন প্রকল্প কাটছাঁট করছে, তাতে শেষ পর্যন্ত কত টাকা ব্যয় করা যাবে, বলা কঠিন।

বিশেষজ্ঞদের মতে, সাধারণত নতুন সড়ক নির্মাণের পাঁচ বছরের মধ্যে সংস্কার করা হয় না। কিন্তু আমাদের সওজ কিংবা গ্রামীণ সড়কের অবস্থা এতটাই দুর্বল যে নির্মাণের পর বছর পার না হতেই অনেক স্থানে ভাঙতে শুরু করে। দু-তিন বছরের মধ্যেই সড়ক বেহাল হয়ে যায়। সরকারের জাতীয় সড়কব্যবস্থার শ্রেণিবিন্যাস অনুযায়ী, দেশের সব উপজেলা সড়ক এবং ইউনিয়ন সড়কের একক দায়িত্ব এলজিইডির। গ্রামীণ সড়কের উন্নয়ন ও রক্ষণাবেক্ষণও করে থাকে তারা। বর্তমানে সংস্থাটির আওতায় ৩ লাখ ৩০ হাজার ৮৩১ কিলোমিটার সড়ক আছে; যার ৪৫ শতাংশ পাকা, ৫৫ শতাংশ কাঁচা।

যেখানে সড়ক যোগাযোগে সরকার বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনার দাবি করছে, সেখানে গ্রামীণ সড়কের ৫৫ শতাংশ কাঁচা থাকা দুর্ভাগ্যজনক। স্বীকার করতেই হবে, সরকারের পরিকল্পনাতেই গলদ আছে। যদি আমরা উন্নয়নের সুফল বৃহত্তর জনগণের কাছে পৌঁছাতে চাই, তাহলে উন্নয়ন হতে হবে সুষম। গ্রামীণ সড়কের ওপর কেবল সেখানকার মানুষের দৈনন্দিন জীবন নয়, অর্থনীতির গতিও নির্ভরশীল। গ্রামীণ যোগাযোগ উন্নত হলে সেখানে উৎপাদিত পণ্য সহজে শহরে যাবে, আবার একইভাবে শহরের পণ্যও গ্রামে আসবে।

এলজিইডির প্রকৌশলীরা বলছেন, উপজেলা সড়ক ও ইউনিয়ন সড়কে ৮ দশমিক ২ টন এবং গ্রামীণ সড়কে ৫ টনের বেশি পণ্যবাহী যানবাহন চলাচল নিষিদ্ধ। কিন্তু বাস্তবে এর চেয়ে অধিক ওজনের যানবাহন চলাচল করছে। এ ছাড়া অতিবৃষ্টি, সড়কের পাশের পুকুরের পাড় বাঁধানো না থাকা, বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে সড়কের ক্ষয়ক্ষতি বাড়ছে।

প্রকৌশলীদের এ বক্তব্যের নিশ্চয়ই বাস্তবতা রয়েছে। কিন্তু গ্রামীণ সড়ক নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণকাজের প্রতিটি ধাপে যে দুর্নীতি, অপচয় ও স্বেচ্ছাচারিতা হয়, তার কী হবে? প্রকল্প–সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে ঠিকাদারদের একধরনের আঁতাত থাকে। ফলে নিম্নমানের মালামাল নিয়ে সড়ক নির্মাণ করা হয়। অনেক ক্ষেত্রে যাঁরা জবাবদিহি আদায় করবেন, তাঁরাও অসহায়। উন্নয়নের নামে এই দুষ্টচক্রের আঁতাত ভেঙে দিতে না পারলে গ্রামীণ সড়কের দুরবস্থা কাটবে না।