অপরিকল্পিত উন্নয়ন

জলাশয়কে কেন্দ্র করে অপরিকল্পিত উন্নয়নের যত ধরনের নমুনা আছে, সবই যদি এক জায়গার মধ্যে দেখতে চান, আপনাকে চলনবিল যেতে হবে। এ উন্নয়নের বিষবৃক্ষ থেকে কী অমৃত ফল আমরা লাভ করেছি, এটা দেখতে হলেও আপনাকে চলনবিলে যেতে হবে। রেললাইন। সড়ক ও মহাসড়ক। সেতু, কালভার্ট, স্লুইসগেট ও বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধ। গ্রোথ সেন্টার। কত নাম বলব? আসলে কী কী হয়েছে তার চেয়ে সহজ কী হয়নি, তার তালিকা করা। ১৯৯৫ থেকে ২০১০—শুধু এ ১৫ বছরেই পাকা সড়ক হয়েছে ১ হাজার ১৮৮ কিলোমিটার, সেতু ১১৩টি, কালভার্ট ৮৫৫টি, গ্রোথ সেন্টার ৯০টি ও স্লুইসগেট ২১টি।

ফলে ছোট হতে হতে এখন মরতে বসেছে চলনবিল। ১৮২৭ সালে যে বিলের আয়তন ছিল ১ হাজার ৪২৪ বর্গকিলোমিটার, তা-ই এখন মাত্র ১৬৮ বর্গকিলোমিটার। ২০০ বছরের কম সময়ে আট ভাগের সাত ভাগই নাই হয়ে গেছে। সেই সঙ্গে কমেছে মাছ আর পানি। ১৯৮২ সালেও বিল থেকে মাছ পাওয়া গেছে ২৭ হাজার টন, ২০০৬ সালে তা কমে হয়েছে ১২ হাজার টন। ২৫ বছরে ৭২ শতাংশ কমেছে। একসময় সারা বছরই বিলে পানি থাকত। এখন শুকনা মৌসুমে কোথাও প্রায় পানি নেই। পাঁচ-ছয় বছর আগেও ২৭-২৮ ফুট নিচে পানি মিলত, এখন ১০০ ফুট গভীরেও পানি মিলছে না।

এত অনিয়ম, এত যে অত্যাচার; তারপরও যতটুকু আছে, তা-ও কম নয়। পাবনা, নাটোর ও সিরাজগঞ্জের ১০টি উপজেলাজুড়ে ছড়িয়ে আছে এ বিল। বিলের মধ্যে এখনো টিকে আছে ছোট–বড় ২১টি নদ-নদী, ৭১টি নালা-খাল ও ৯৩টি ছোট বিল। এখনো ১ হাজার ৬০০ গ্রামের মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বিলটির ওপর নির্ভরশীল।

তার চেয়ে বড় কথা, এখনো এটাকে বাঁচিয়ে তোলা যায়। সে জন্য রাজনৈতিক ও আঞ্চলিক প্রতিশ্রুতি রাখতে বিচ্ছিন্ন ও অপরিকল্পিত যেসব উন্নয়নকাজ চালানো হয়, প্রথমেই এগুলো বন্ধ করতে হবে। পরিকল্পনা, ভূমি, কৃষি, পানিসম্পদ, নৌ, স্থানীয় সরকার, মৎস্য ও পরিবেশ—সব মন্ত্রণালয় মিলে সমন্বিত পরিকল্পনা করতে হবে। এর বাইরে কোনো কাজ করা যাবে না। পানির স্বাভাবিক প্রবাহ ফিরিয়ে আনতে অপ্রয়োজনীয় ব্রিজ-কালভার্ট ও স্লুইসগেট অপসারণ করতে হবে। যেসব রাস্তা ও সেতু রাখা একান্তই জরুরি, সেগুলোও প্রকৃতিবান্ধব করে বানাতে হবে। বিলের মধ্যে পুকুর খোঁড়া বন্ধ করতে হবে। ভরাট হয়ে যাওয়া নদ-নদী-নালা-খাল খনন করে মাটির ওপরের পানির স্তর স্বাভাবিক করতে হবে। তাহলে মাটির তলের পানির স্তরও স্বাভাবিক হবে। ফিরে আসবে জলজ উদ্ভিদ ও প্রাণী। প্রাণ পাবে চলনবিল।