আক্রান্ত সোহরাওয়ার্দী উদ্যান

সম্পাদকীয়

ঢাকা শহরের ফুসফুস হিসেবে পরিচিত সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গাছপালা কেটে যে রেস্তোরাঁসহ বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ করা হচ্ছে, তা যেমন পরিবেশকে ধ্বংস করবে, তেমনি উদ্যানের চরিত্রও।

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সঙ্গে আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্য তথা স্বাধীনতাসংগ্রামের নিবিড় সম্পর্ক আছে। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ এ উদ্যান থেকে বঙ্গবন্ধু ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ ঘোষণা করেছিলেন। আবার ওই বছর ১৬ ডিসেম্বর দখলদার পাকিস্তানি সেনারা নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করেছিল এ উদ্যানেই। স্বাধীনতাসংগ্রামের সেই স্মৃতিকে সমুজ্জ্বল করে রাখতে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্থাপন করা হয়েছে স্বাধীনতাস্তম্ভ। উদ্যানের সবুজ রক্ষার তাগিদে সেই স্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছিল ভূগর্ভে, যার পাশে বিশাল জলাশয়। সবুজ আর জলাশয়ের মিশ্রণে সেখানে প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষিত হয়েছে। নতুন স্থাপনা কেবল সোহরাওয়ার্দী উদ্যান নয়, স্বাধীনতাস্তম্ভের সৌন্দর্যও নষ্ট করবে।

আমাদের নীতিনির্ধারকদের মাথায় অদ্ভুত সব খেয়াল চাপে। খালি জায়গা দেখলেই তাঁদের স্থাপনা নির্মাণ করার শখ জাগে। কেননা স্থাপনা মানে প্রকল্প ঠিকাদারি কমিশন, কাউকে কাজ পাইয়ে দেওয়া ইত্যাদি। সেই খেয়ালেই তাঁরা ২০১৮ সাল থেকে প্রকল্পের তৃতীয় পর্যায়ে ভূগর্ভস্থ গাড়ি পার্কিং, দৃষ্টিনন্দন জলাধারসহ হাঁটাপথ, আন্ডারপাস, মসজিদ, অত্যাধুনিক রাইডসহ শিশুপার্কের আধুনিকায়ন, খাবারের দোকান, বৈদ্যুতিক সাবস্টেশন ইত্যাদি নির্মাণের কাজ করে আসছেন। যেখানে স্বাধীনতার স্তম্ভ ও শিখা চিরন্তন আছে, সেখানে আরও নতুন নতুন স্থাপনা নির্মাণের কী যুক্তি থাকতে পারে? স্বাধীনতাস্তম্ভের চারপাশে কংক্রিটের জঙ্গল তৈরি করলেই মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষিত হয় না।

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানসহ ঐতিহাসিক স্থানগুলো সংরক্ষণের বিষয়ে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা আছে। গাছপালা রেখেই এখানে উন্নয়নকাজ করতে হবে। কোনো উন্নয়ন প্রকল্পের নামে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা উপেক্ষা করা যাবে না। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের পাশেই রমনা চত্বরে বিশাল রেস্তোরাঁ আছে, যা বেশির ভাগ সময় খালি পড়ে থাকে। এ অবস্থায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আরও রেস্তোরাঁ নির্মাণের যুক্তি আছে বলে মনে করি না।

যেকোনো শহরে ২৫ শতাংশ সবুজ থাকা বাঞ্ছনীয়। কিন্তু ঢাকা শহরের পুরোনো অংশে মাত্র ৫ শতাংশ এবং নতুন অংশে ১২ শতাংশ সবুজ আছে। এর আগে আমরা অনেকগুলো উদ্যান নষ্ট করেছি। সরকারের নীতিনির্ধারকদের চেয়ে পরিবেশবাদীরা যে অনেক বেশি দূরদৃষ্টিসম্পন্ন, তার প্রমাণ বাংলাদেশ–চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্র। আওয়ামী লীগ সরকার ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে ওসমানী উদ্যানে এটি স্থাপনের উদ্যোগ নিলে পরিবেশবাদীরা বাধা দেন। শেষ পর্যন্ত সরকার সেটি আগারগাঁওয়ে সরিয়ে নিতে বাধ্য হয়। সে সময় পরিবেশবাদীদের কথা না শুনে যদি সরকার সে সময় ওসমানী উদ্যোনেই মিলনায়তনটি করত, তাহলে কী অবস্থা তৈরি হতো? অবিলম্বে সেই মিলনায়তন পরিত্যক্ত ঘোষণা করতে হতো।

তাই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের সেই বহুল প্রচলিত বাংলা প্রবাদটিই স্মরণ করিয়ে দেব, ‘ভাবিয়া করিও কাজ করিয়া ভাবিও না’। অবিলম্বে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সব অপ্রয়োজনীয় স্থাপনা নির্মাণ বন্ধ রাখতে হবে। কোনো অজুহাতেই গাছ কেটে সেখানে রেস্তোরাঁ করা যাবে না। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা শহরে অবস্থিত ময়দান শত বছরেও তার চরিত্র অক্ষুণ্ন রাখতে পেরেছে। আর আমরা অর্ধশত বছরের কম সময়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানকে ধ্বংসের কিনারে নিয়ে এসেছি। এই অবিমৃশ্যতার জবাব কী?