আন্তর্জাতিক নারী দিবস

সম্পাদকীয়

নারী-পুরুষ বৈষম্যের পৃথিবীতে যখন অতিসংক্রামক এক মহামারি হানা দিয়েছে, তখন নারীর নাজুকতা তুলনামূলকভাবে বেশি প্রকটিত হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে বৈষম্য কমিয়ে সমতা অর্জনের পথে আরও এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় ঘোষিত হয়েছে এ বছরের আন্তর্জাতিক নারী দিবসে। জাতিসংঘ এবার এই দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করেছে ‘নেতৃত্বে নারী: কোভিড-১৯ বিশ্বে সমতাপূর্ণ ভবিষ্যৎ অর্জন’ (উইমেন ইন লিডারশিপ: অ্যাচিভিং অ্যান ইকুয়াল ফিউচার ইন আ কোভিড-১৯ ওয়ার্ল্ড)। আজ ৮ মার্চ, আন্তর্জাতিক নারী দিবসে আমরা বাংলাদেশসহ বিশ্বের সব নারীকে আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানাচ্ছি।

কোভিড-১৯ সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার পুরুষের তুলনায় নারীদের মধ্যে অনেক কম, কিন্তু এই মহামারির অর্থনৈতিক ও সামাজিক অভিঘাতের চিত্রটি ঠিক উল্টো। এ ক্ষেত্রে নারীই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত, নারীর অবস্থাই সবচেয়ে নাজুক। এই দেশে মোট শ্রমশক্তির মাত্র ৩৬ দশমিক ৩ শতাংশ নারী, তাঁদের মধ্যে ৯১ দশমিক ৮ শতাংশ কাজ করেন অনানুষ্ঠানিক খাতে। আর চলমান মহামারিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অনানুষ্ঠানিক খাত। অর্থাৎ প্রত্যক্ষ অর্থনৈতিক ক্ষতির পাল্লা নারীর দিকেই ভারী। উপার্জনক্ষম নারী যখন অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন, তখন তাঁর সামাজিক ও পারিবারিক অবস্থানও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

কিন্তু মহামারি মোকাবিলায় সম্মুখসারির যোদ্ধা হিসেবে যাঁরা লড়াই করে চলেছেন, তাঁদের সিংহভাগই নারী। নার্সদের ৯৪ শতাংশ নারী, স্বাস্থ্যকর্মীদের ৯০ শতাংশ নারী। কোভিডের সময়ে তাঁদের কাজের চাপ অনেক বেড়েছে, যথারীতি গৃহ সামলানোর পাশাপাশিই তাঁরা বাড়তি দায়িত্ব পালন করে চলেছেন। স্বাস্থ্যগত ঝুঁকির কথা বলা বাহুল্য: চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে যাঁরা কোভিডে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন এবং ভুগেছেন, তাঁদের মধ্যে নারীরাও আছেন। ‘কোভিড-১৯ বাংলাদেশ র‌্যাপিড জেন্ডার অ্যানালাইসিস’ নামে ইউএন উইমেন-এর জেন্ডার ইন হিউম্যানিটারিয়ান অ্যাকশন ওয়ার্কিং গ্রুপের এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, কোভিডের সময় চিকিৎসাসেবা ও তথ্য পাওয়ার ক্ষেত্রেও নারীরা বৈষম্যের শিকার হয়েছেন।

স্বাভাবিক সময়ে আমাদের নারীরা যেসব বৈষম্যের শিকার হন, এই মহামারিকালে সেগুলো কমেনি, বরং কিছু ক্ষেত্রে বেড়েছে। সরকারি সূত্রে জানানো হয়েছে, দেশের বিভিন্ন জেলায় বাল্যবিবাহের ঘটনা বেড়েছে। গৃহের ভেতরে সহিংস আচরণ, বিবাহবিচ্ছেদ, যৌতুকের দাবিতে নির্যাতন ইত্যাদিও বেড়েছে। যদিও বিদ্যালয় বন্ধ রয়েছে, তবু ওয়াকিবহাল মহল আশঙ্কা প্রকাশ করেছে যে এই মহামারির কারণে বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়ার হার বাড়বে এবং তার প্রধান শিকার হবে মেয়েশিশুরা।

বাংলাদেশ নারী-পুরুষ বৈষম্য লাঘব করা এবং নারী সমাজের অগ্রগতির বিভিন্ন সূচকে ক্রমান্বয়ে যে সাফল্য অর্জন করে চলেছে, কোভিড-১৯ মহামারির কারণে সেই ধারাবাহিকতায় কিছুটা ছেদ পড়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। লিঙ্গবৈষম্য কমানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে, আমাদের এই সাফল্যের ধারা অব্যাহত রাখতে হলে চলমান মহামারি মোকাবিলা এবং তার পরের ধাপগুলোতে নীতিনির্ধারণ ও অর্থ বরাদ্দের ক্ষেত্রে নারী সমাজকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। কর্মসংস্থান হারানো, আয় কমে যাওয়া ইত্যাদি কারণে জীবনযাত্রার মানে যে অবনতি ঘটেছে, তার বিরূপ প্রভাব নারীদের ওপরেই বেশি পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাহলে নারী ও মেয়েশিশুদের স্বাস্থ্য ও পুষ্টি পরিস্থিতির অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত হবে। এই দিকে বিশেষ দৃষ্টি রাখতে হবে। কোভিড-১৯ মহামারিতে আক্রান্ত বাংলাদেশে নারীর অগ্রগতির ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য আরও যা প্রয়োজন, তা হলো ঘরে-বাইরে সর্বত্র নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জোরালো উদ্যোগ।