আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস

আজ একুশে ফেব্রুয়ারি; আমাদের ভাষাশহীদ দিবস। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। পৃথিবীর সব জাতিগোষ্ঠীর মানুষের মাতৃভাষার অধিকার ও মর্যাদার স্বীকৃতি স্মরণ করিয়ে দেওয়ার এই দিন বাঙালির জন্য বিশেষভাবে আবেগময় স্মৃতি বহন করে। কারণ, ১৯৫২ সালের এই দিনে মাতৃভাষা বাংলার অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবি জানাতে গিয়ে আমাদের তরুণেরা ঢাকার রাজপথে বুকের রক্ত ঢেলে দিয়েছিলেন। আজ আমরা গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার সঙ্গে স্মরণ করছি ভাষাশহীদ সালাম, রফিক, বরকত, জব্বার, শফিউরসহ সবাইকে।

এ বছর দিবসটি যখন এল, তখন বাংলাদেশসহ সারা পৃথিবীতে চলছে কোভিড-১৯ মহামারি। তাই একুশে ফেব্রুয়ারি উদ্‌যাপনের স্বাভাবিক আনুষ্ঠানিকতার সুযোগ নেই। শহীদ মিনারে ভাষাশহীদদের শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের কর্মসূচি সংগত কারণেই নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। পুরো ফেব্রুয়ারি মাস ধরে বাংলা একাডেমির উদ্যোগে যে বইমেলা চলে, এবার তা পিছিয়ে মার্চ মাসের ১৮ তারিখে শুরু করার পরিকল্পনা করা হয়েছে।

একুশে ফেব্রুয়ারি এলে আমরা মাতৃভাষা বাংলার প্রতি ভালোবাসার প্রকাশ ঘটাই; কিন্তু আমাদের সারা বছরের কাজকর্মে সেই আবেগের প্রকাশ থাকে না। বাংলা ভাষা নিয়ে আমাদের গৌরবের প্রকাশ ঘটতে পারত রাষ্ট্র ও সমাজের সর্বস্তরে এই ভাষার প্রচলনের মাধ্যমে। কিন্তু বাস্তবে তা ঘটেনি। শিক্ষাক্ষেত্র, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গনে বাংলা ভাষা অবহেলার শিকার। সামাজিকভাবে বিভিন্ন অনুষ্ঠান-আপ্যায়নের নিমন্ত্রণপত্র থেকে শুরু করে দোকানপাটের পণ্য বিক্রির তালিকা কিংবা অর্থ লেনদেনের রসিদে পর্যন্ত বাংলা ভাষার ব্যবহার প্রতিষ্ঠা পায়নি।

কিন্তু মাতৃভাষার প্রতি এ অবহেলা কেন? বিশ্বায়ন একটা কারণ; কিন্তু বিশ্বায়নের অন্তর্ভুক্ত অনেক জাতিই তো নিজ নিজ মাতৃভাষার ব্যবহার ও মর্যাদা অক্ষুণ্ন রেখে দেশি-বিদেশি যোগাযোগের কাজ সম্পন্ন করে চলেছে। ইংরেজিসহ কয়েকটি ঔপনিবেশিক ভাষার আন্তর্জাতিক প্রভাব সত্ত্বেও এশিয়ায় চীনা, জাপানি, কোরীয়, থাই, তামিল, তেলেগু, হিন্দি ভাষার মানুষেরা নিজ নিজ মাতৃভাষার উৎকর্ষ সাধন করে চলেছে। তাহলে আমাদের সমস্যা কী? আমাদের শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর কাছে বাংলা ভাষার চেয়ে ইংরেজির মর্যাদা কেন বেশি বলে মনে হচ্ছে? এমনকি সাহিত্য-শিল্প-সংস্কৃতিজগতের সামর্থ্যবান পরিবারগুলোও কেন সন্তানদের জন্য ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকেই শ্রেয় মনে করছে?

এসব আত্মজিজ্ঞাসা শুধু ফেব্রুয়ারি মাসের বিষয় নয়। তবে একুশে ফেব্রুয়ারিতে ভাষাশহীদদের স্মরণের পাশাপাশি এসব জিজ্ঞাসাও আমাদের তাড়িত করে। আমাদের শিক্ষা কার্যক্রম, প্রতিষ্ঠান পরিচালনাসহ সব কাজে বাংলা ভাষাকে স্বয়ংসম্পূর্ণতার পথে নিয়ে যেতে হবে। সে জন্য উপযুক্ত পরিভাষা কাঠামো গড়ে তুলতে হবে। একটি মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়নের মাধ্যমে সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলনের উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।

স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা লাভের পর দীর্ঘ প্রায় পাঁচ দশকেও আমরা এ কাজে কেন বেশি অগ্রসর হতে পারিনি, তা আজ আমাদের ভেবে দেখতে হবে। সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলনের মাধ্যমেই ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন সম্ভব। শুধু বাংলা নয়, বাংলাদেশ ভূখণ্ডে আরও যে ভাষার মানুষ আছে, তাদেরও নিজ নিজ মাতৃভাষার বিকাশের উদ্যোগ বেগবান করার উদ্যোগ নিতে হবে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মর্মবাণী সেটাই।