আবাসিক হলের খাবার

সত্তরের দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন উপাচার্যকে কারাগারে যেতে হয়েছিল আবাসিক হলগুলোয় যে সংখ্যক শিক্ষার্থী ছিলেন, তার চেয়ে বেশি রেশন কার্ড করার দায়ে। আত্মপক্ষ সমর্থন করতে গিয়ে ওই উপাচার্য বলেছিলেন, শিক্ষার্থীরা যাতে কম পয়সায় খেতে পারেন, সে জন্য এই ব্যবস্থা করা হয়েছিল। শিক্ষার্থীদের সংখ্যার চেয়ে বেশি রেশন কার্ড করা নিশ্চয়ই সমর্থনযোগ্য নয়। কিন্তু তিনি এটি করেছিলেন শিক্ষার্থীদের কল্যাণচিন্তা থেকে।

বর্তমানে যাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদাধিকারী, তাঁরা শিক্ষার্থীদের সমস্যা নিয়ে যে খুব ভাবিত নন, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের চলমান আন্দোলনই তার প্রমাণ। গত বুধবার প্রথম আলোয় প্রধান শিরোনাম ছিল, শিক্ষার্থীরা কী খাচ্ছেন, নজর নেই কারও। এই প্রতিবেদনে ছয়টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলের ক্যানটিনের যে চিত্র উঠে এসেছে, তা উদ্বেগজনক। আবাসিক হলের পাতলা ডালের ‘খ্যাতি’ সর্বজনবিদিত। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মাছ বা মাংসের যথাসম্ভব ছোট টুকরো এবং বাজারের সবচেয়ে নিম্নমানের মোটা চালের ভাত। বিনিময়ে প্রতি বেলা খাবারের জন্য নেওয়া হয় ৩৫ থেকে ৪০ টাকা। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থেকে শিক্ষার্থীদের খাবারের জন্য কোনো ভর্তুকি দেওয়া হয় না। কেননা বাজেট কম। বাজেট কম বলে নতুন নতুন দালানকোঠা নির্মাণ থেমে নেই। থেমে নেই বছরব্যাপী আড়ম্বর অনুষ্ঠানাদিও। শিক্ষার্থীদের খাবারদাবারের প্রশ্ন এলেই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বাজেটের দোহাই দেয়।

শিক্ষার্থীদের এ জ্বলন্ত সমস্যা যে তাঁদের মাথায় ছিল না, সেটি বোঝা গেল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামানের বক্তব্যে। তিনি বলেছেন, শিগগিরই হল প্রশাসনের সঙ্গে এ বিষয়ে বৈঠক করবেন। এত দিন কেন করলেন না? প্রথম আলোর প্রতিবেদনে আরও বেরিয়ে এসেছে যে আবাসিক হলের ক্যানটিনের খাবারের নিম্নমানের পেছনে সরকার-সমর্থক ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের ‘হাত’ আছে। একদিকে তাঁদের অনেকে ফাউ খান এবং খাবারের বিল দেন না, অন্যদিকে হল ক্যানটিনের ইজারাদারদের ছাত্রলীগের হুকুমে চলতে হয়। অনেক ক্ষেত্রে ছাত্রলীগই ঠিক করে দেয় কে ইজারা পাবেন, কে পাবেন না। সম্প্রতি খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষককে জীবন দিতে হলো ছাত্রলীগের সঙ্গে বিরোধের জের ধরে।

‘বাজেট কম’ থাকার কারণে শিক্ষার্থীদের খাবারের ক্ষেত্রে ভর্তুকি দেওয়া যাচ্ছে না বলে যে যুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তরফে তোলা হচ্ছে, তার পাল্টা হিসেবে প্রশ্ন করা যায়, শিক্ষার্থীদের খাবারের মান নিয়ে আদৌ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কর্তৃপক্ষের কোনো মাথাব্যথা আছে কি? এ খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর জন্য সরকারের সঙ্গে জোরালো দেনদরবার করেছে কি? উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের জন্য বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ পাওয়া গেলে, শিক্ষার্থীদের খাবারে ভর্তুকি দেওয়ার জন্য বাজেট মিলবে না কেন?

আবাসিক হলে শিক্ষার্থীদের খাবার নিয়ে গবেষণা করেছিলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষক। এতে দেখা যায়, হলের একজন শিক্ষার্থী দৈনিক গড়ে পুষ্টি পান ১ হাজার ৮২১ কিলোক্যালরি। অথচ একজন সুস্থ মানুষের প্রয়োজন ২ হাজার ৮০০ কিলোক্যালরি। এর কম পেলে তাকে দারিদ্র্যসীমার নিচে ধরা হয়। পুষ্টি গ্রহণের বিবেচনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা দারিদ্র্যসীমার নিচে থেকেই উচ্চশিক্ষা নিচ্ছেন।

আমরা চাই শিক্ষার্থীদের খাবারের মান নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের টনক নড়ুক। শিক্ষার্থীদের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি যেন নিশ্চিত হয়, সেই মানের খাবার পরিবেশনের উদ্যোগ নেওয়া হোক। ছাত্রলীগের ফাউ ও বাকি খাওয়া বন্ধ হলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের খাবার মান কিছুটা বাড়বে। প্রাথমিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে তা নিশ্চিত করতে হবে। খাবারের খাতে বাড়তি বরাদ্দ পাওয়ার আগে অন্য খাতে বরাদ্দ কমিয়ে হলেও আবাসিক হলের শিক্ষার্থীদের ভর্তুকি দিতে হবে।