ইরফান সেলিমের শাস্তি

সরকারদলীয় সাংসদ হাজি সেলিমের ছেলে ইরফান সেলিমের বিরুদ্ধে অস্বাভাবিক দ্রুতগতিতে আইনের প্রয়োগ ও দণ্ডদানের ঘটনা এ মুহূর্তে দেশের জাতীয় সংবাদমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সর্বাধিক আলোচিত বিষয়। এর কারণ শুধু এই নয় যে ক্ষমতাসীন দলের একজন প্রভাবশালী সাংসদের ছেলেকে অবৈধ অস্ত্র, মাদকদ্রব্য, ওয়াকিটকি ইত্যাদি বেআইনি জিনিসপত্র রাখার দায়ে হাতকড়া পরিয়ে গ্রেপ্তার করে ভ্রাম্যমাণ আদালতের দ্বারা দণ্ড দেওয়া হয়েছে; বরং আলোচনার কারণ এটাও যে সাংসদপুত্র ইরফানের এই পরিণতি হয়েছে গ্রেপ্তারের আগের রাতে রাস্তায় নৌবাহিনীর এক কর্মকর্তাকে প্রহার করার কারণে।

এই ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও নাগরিক সমাজে যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা যাচ্ছে, সেগুলোর মধ্যে একটি হলো এ রকম যে ইরফান সেলিম ও তাঁর লোকজন সেদিন রাতে যে ব্যক্তিকে রাস্তায় প্রহার করে রক্তাক্ত করেছেন, তিনি ঘটনাক্রমে বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীগুলোর একটির একজন সদস্য। প্রহৃত ব্যক্তিটি ঘটনাক্রমে ‘আমজনতার’ সদস্য হলে এত ত্বরিত কিছু ঘটত না বলেই জনমনের সাধারণ ধারণা। বাংলাদেশে অপরাধ সংঘটন এবং অপরাধীদের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগের সাধারণ চিত্রের দিকে তাকালে এই প্রবণতা ধরা পড়ে। এ দেশে রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাধর ব্যক্তি, তঁাদের পুত্রকন্যা-আত্মীয়স্বজনের কেউ কোনো গুরুতর ফৌজদারি অপরাধ করলেও তাঁর বিরুদ্ধে আইনের যথাযথ প্রয়োগ ঘটে না। ‘বিচারহীনতার সংস্কৃতি’ বলে যে শব্দবন্ধটি ব্যাপকভাবে প্রচলিত হয়েছে, তার সঙ্গে রাজনৈতিক ক্ষমতার সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়।

এ দেশে ‘রাজনৈতিক ক্ষমতা’ এখন কুক্ষিগত হয়েছে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের হাতে। এই দল, তার অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর সব পর্যায়ের নেতা–কর্মীদের একাংশের মধ্যে এমন এক আত্মবিশ্বাস দৃঢ় মূল হয়েছে যে তাঁরা দেশের প্রচলিত সব আইন-কানুনের ঊর্ধ্বে উঠে গেছেন; অন্যায়-অপরাধ করে বিচার ও শাস্তির মুখোমুখি হতে হয় না। তাঁদের এমন আত্মবিশ্বাসের কারণ বাস্তব: তাঁদের কৃত অপরাধের আইনি প্রতিকারের পথ বন্ধ করে দেওয়া হয়; থানা-পুলিশ সক্রিয় হয় না; মামলা গ্রহণ করা হয় না; হলে তদন্ত ঠিকমতো হয় না, অভিযোগ তৈরি হয় না—মোট কথা আইন তার স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় কাজ করে না। ফলে নারায়ণগঞ্জ কিংবা ফরিদপুর, ফেনী কিংবা লক্ষ্মীপুর হয়ে ওঠে ‘অপরাধের স্বর্গরাজ্য’; এবং এই জেলাগুলোর সঙ্গে জড়িয়ে থাকে ক্ষমতাসীন দলের কোনো না কোনো নেতা, তাঁদের পুত্র, ভাই-ভাতিজার নাম। আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রতিবন্ধকতার কারণে রাজধানী থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল পর্যন্ত খুন-ধর্ষণসহ নানা ধরনের অপরাধবৃত্তি বেড়ে চলেছে।

ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক নেতৃত্বের আইনের প্রতি শ্রদ্ধা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার আন্তরিক অঙ্গীকার থাকলে আইন সব ক্ষেত্রে সমানভাবে কাজ করতে পারত। বাংলাদেশে যে তা করছে না, জনসাধারণ খোলা চোখেই তা দেখতে পাচ্ছে। মাঝেমধ্যে হঠাৎ ইরফান সেলিমের গ্রেপ্তার হওয়া এবং দণ্ড পাওয়ার ঘটনায় জনমনে এমন আস্থা ও স্বস্তি ফিরে আসতে পারে না যে আইনের শাসনের একটি দৃষ্টান্ত পাওয়া গেল। কারণ, এটা আইনের বাছাই করা প্রয়োগের একটি ঘটনা, ইংরেজিতে যাকে বলা হয় ‘সিলেকটিভ জাস্টিস’। এর আগে কক্সবাজারে পুলিশ সদস্যদের হাতে সেনাবাহিনীর একজন সাবেক কর্মকর্তা নিহত হওয়ার পর হত্যার সঙ্গে জড়িত পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগের ঘটনাটিও একই রকমের ব্যতিক্রমী ঘটনা। উভয় ঘটনায় দ্রুত আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে সক্রিয়তা অবশ্যই সংঘটিত অপরাধের আইনি প্রতিকারের স্বাভাবিক প্রত্যাশা জাগায়। তবে এভাবে বেছে বেছে আইন প্রয়োগের মধ্য দিয়ে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। আইনের দৃষ্টিতে সবাই সমান; রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, প্রাতিষ্ঠানিক–নির্বিশেষে সব ধরনের প্রভাব অগ্রাহ্য করে সব ক্ষেত্রে আইনের যথাযথ প্রয়োগের পথেই এগোতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।