ইসির আইনবিলাস

নির্বাচন কমিশনের (ইসি) কাজ হলো ভোটারদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করা, যাতে তাঁরা পছন্দসই প্রার্থী বেছে নেওয়ার সুযোগ পান। কিন্তু কে এম নূরুল হুদা কমিশন ভোটারদের ভোটাধিকার সুরক্ষা ছাড়া সবই করছেন। তঁারা ১৯৭২ সালের জনপ্রতিনিধিত্ব আদেশের নাম পরিবর্তনের প্রস্তাব দিয়েছেন, প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিল কিংবা তাঁকে জরিমানা করার যে বিধান বর্তমান আইনে আছে, সেটিও বাতিল করার প্রস্তাব দিয়েছেন। নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা কমিশনের এ উদ্যোগকে অপ্রয়োজনীয় ও অযৌক্তিক বলে অভিহিত করেছেন।

যেকোনো আইন করতে হলে অংশীজনের মতামত নেওয়া অপরিহার্য। কিন্তু নির্বাচন কমিশন আইন সংশোধনে কারও সঙ্গে আলাপ করার প্রয়োজন বোধ করেনি। ইসির এ উদ্যোগে বাইরের সমালোচনা তো আছেই, পাঁচ সদস্যের কমিশনের একজন সদস্যও আপত্তি জানিয়েছেন। আরেকজন সদস্য বলেছেন, প্রাথমিক খসড়ায় প্রার্থিতা বাতিল ও জরিমানার বিষয়টি ছিল। পরে বাদ দেওয়া হয়েছে। তাহলে কি দুজন কমিশনারের অজ্ঞাতে এটি বাদ দেওয়া হয়েছে?

নির্বাচনী আইনের উদ্দেশ্য হলো একটি সুষ্ঠু, অবাধ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের ক্ষেত্রে কোনো বাধা থাকলে সেটি অপসারণ করা। কিন্তু কে এম নূরুল হুদা কমিশন নির্বাচন অনুষ্ঠানের বাধাগুলো দূর করার ক্ষেত্রে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। বরং নির্বাচনপ্রক্রিয়া সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ করতে যেসব বিধান ছিল, সেগুলো তুলে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে। এমনকি আইন মন্ত্রণালয় কমিশনের পাঠানো প্রস্তাব ফেরত দেওয়ার পরও কমিশন তার অপপ্রয়াস চালিয়েই যাচ্ছে।

নির্বাচন কমিশনের আরেকটি তুঘলকি কাণ্ড হলো নাম পরিবর্তন। স্থানীয় সরকার সংস্থায় ‘ইউনিয়ন’, ‘মেয়র’, ‘প্রেসিডেন্ট’, ‘চেয়ারম্যান’ ইত্যাদি শব্দ শত শত বছর চলে আসছে। এগুলো বাদ দেওয়ার কী যুক্তি আছে? ইসির প্রস্তাব অনুযায়ী সব নাম যদি খাঁটি বাংলা করতে হয়, তাহলে তো নির্বাচন কমিশনের ‘কমিশন’ শব্দটিরও তো বাংলা করতে হয়। আর এর কমিশনারদের তখন কী নামে ডাকা হবে? কমিশনকে খাঁটি বাংলা খোঁজার ঘোড়া রোগে পেল কেন?

সৎ উদ্দেশ্য ও বৃহত্তর স্বার্থে যদি নির্বাচনী আইনের কোনো সংশোধনী আনা হয়, সেটি গ্রহণ করতে আপত্তি থাকার কথা নয়। কিন্তু দেখা যাচ্ছে নির্বাচন কমিশনের আইন সংশোধনের উদ্দেশ্য হচ্ছে নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে আরও দুর্বল ও ভঙ্গুর করা। অতীতে ভোটার তালিকা প্রণয়ন নিয়ে ব্যাপক জালিয়াতি হতো। এর প্রতিকারে ২০০৭ সালে এ টি এম শামসুল হুদা কমিশন জাতীয় পরিচয়পত্রসহ ভোটার তালিকা তৈরি করে। কমিশন রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন আইনের যে খসড়া অনুমোদন দিয়েছে, রাজনৈতিক দলের নিবন্ধনসংক্রান্ত সব বিধান আরপিওতে অন্তর্ভুক্ত আছে। সেখানে নতুন আইন করার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না।

আরপিওতে রাজনৈতিক দলের কমিটিতে এক-তৃতীয়াংশ নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার বিধান ছিল। সে জন্য ২০২০ সাল পর্যন্ত নির্দিষ্ট মেয়াদ বেঁধে দেওয়া হয়েছিল। আরপিওতে এ উপধারা সংযোজন করা হয়েছিল নারী নেতৃত্ব বিকাশের স্বার্থে। একে আরও সম্প্রসারিত করে ভবিষ্যতে ৫০ ভাগে উন্নীত করার কথা বলা আছে। অথচ নতুন প্রস্তাবনায় পুরোনো সময়সীমা ২০২০ সাল বাদ দিয়ে উন্মুক্ত রাখার প্রস্তাবনা রাখা হয়েছে। এটা একেবারেই অগ্রহণযোগ্য।

কে এম নূরুল হুদা কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার তিন বছরের বেশি সময় পার হয়েছে। এর মধ্যে তারা একটি সুষ্ঠু নির্বাচনও করতে পারেনি। এ অবস্থায় নির্বাচনী আইন সংশোধনের নামে নির্বাচনপ্রক্রিয়াকে আরও দুর্বল করার এ অপপ্রয়াস কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। অকাজ বাদ দিয়ে ইসির উচিত নির্বাচনী ব্যবস্থার যে ক্ষতি তারা করেছে সেই ক্ষতি পূরণ করা, নতুন কোনো সর্বনাশ না করা। ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যাবে জনগণ রাজনীতিকদের ক্ষমা করলেও নির্বাচন কমিশনকে ক্ষমা করেনি। বাংলাদেশে এমন নজির নেই।