ঋণের জোগান বাড়ান, নিরাপত্তা দিন

করোনাকালে দেশের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নানা হতাশাজনক খবরের মধ্যেও হঠাৎ আলোর ঝিলিক দেখা যায়। যেমন করোনার শুরুতে তৈরি পোশাকশিল্পের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ ছিল বিদেশি ক্রেতা ধরে রাখা। সেই কাজটি তারা ভালোভাবেই করতে পেরেছে। একইভাবে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (এসএমই) খাত, বিশেষ করে নারী উদ্যোক্তাদের প্রতিষ্ঠানে কর্মসংস্থান বাড়ার খবরটি খুবই উৎসাহব্যঞ্জক।

সম্প্রতি আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইডিএলসি ফাইন্যান্স ও গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) যৌথ গবেষণায় দেখা যায়, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের প্রতিষ্ঠানগুলো (এসএমই) গত পাঁচ বছরে গড়ে ১০৫ দশমিক ৭ শতাংশের বেশি নতুন চাকরির সুযোগ তৈরি করেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি কর্মসংস্থান হয়েছে নারী উদ্যোক্তাদের প্রতিষ্ঠানে। এই হার প্রায় ১৪৬ দশমিক ২ শতাংশ।

গবেষণায় আরও বলা হয়, এসএমই খাতের উদ্যোক্তারা প্রথমে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ব্যবসা শুরু করলেও পরে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নতুন কর্মী যুক্ত হয়। ফলে বর্তমানে কর্মসংস্থানের বড় ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে এই খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো। এসএমইর খাতওয়ারি হিসাব করলে দেখা যায়, বেশি কর্মসংস্থান হয়েছে সেবা খাতসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে, ১৭৪ শতাংশ। এ ছাড়া শিল্পে ১৩১ শতাংশ, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে ৭৪ শতাংশ, কৃষিভিত্তিক প্রতিষ্ঠানে ৩০ শতাংশ হারে কর্মসংস্থান হয়েছে। এসএমই খাতে দুই ধরনের কর্মী নিয়োগ করা হয়। বেতনভুক্ত ও দৈনিক মজুরিভিত্তিক। দুটোতেই কর্মসংস্থান বেড়েছে যথাক্রমে ১৩৪ শতাংশ ও ৯৪ শতাংশ হারে। এসব প্রতিষ্ঠানে গড় বিনিয়োগ ছিল ৩ কোটি টাকার মতো। আর বার্ষিক টার্নওভারের পরিমাণ প্রায় ৬ কোটি টাকা।

উল্লেখ্য, এসএমই খাতের অনেক প্রতিষ্ঠানে পারিবারিকভাবে উদ্যোগ নেওয়া হয়। পরিবারের সদস্যরাই এর উদ্যোক্তা ও কর্মী। কিন্তু ব্যবসার প্রসার ঘটলে পরিবারের বাইরে থেকে কর্মী নিয়োগ করা হয়। গত এক দশকে ভারী শিল্প খাতের যখন মন্দাবস্থা চলছে, তখন এসএমই খাতের এই শ্রীবৃদ্ধি অর্থনীতিকেই কেবল গতিশীল করছে না, বেকারত্ব নিরসনেও কার্যকর ভূমিকা রাখছে।

ইংরেজিতে একটি কথা আছে ‘স্মল ইজ বিউটিফুল’। ছোটই সুন্দর। কিন্তু এই খাতের ধারাবাহিক সাফল্য সত্ত্বেও কিছু সমস্যা আছে। সেগুলোর প্রতি সরকার নজর না দিলে এই সাফল্য ধরে রাখা কঠিন হবে। এসএমই খাতের প্রধান সমস্যা হলো অর্থায়ন। উদ্যোক্তারা শুরুতে নিজেদের সঞ্চয় থেকে বিনিয়োগ করেন। কিন্তু ব্যবসা বা শিল্প প্রসারের পর ব্যাংকঋণ জরুরি হয়ে পড়ে। আমাদের ব্যাংকিং ব্যবস্থা ‘তেলা মাথায় তেল’ দিতেই বেশি পছন্দ করে। বড় অঙ্কের ঋণ দিলে ব্যাংকের লাভ বেশি। তাই ছোট উদ্যোক্তাদের অগ্রাহ্য করে। করোনাকালেও দেখা গেছে, সরকার এসএমই খাতে যে অঙ্কের প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছিল, ব্যাংকগুলো সেই অর্থ ছাড় দিতে গড়িমসি করেছে। যদিও এসএমই খাতে ঋণ পরিশোধের হার বৃহৎ শিল্পের চেয়ে অনেক বেশি। এই খাতে খেলাপি ঋণও কম।

অন্যদিকে এই শিল্পের জন্য নিরাপদ জায়গা পাওয়াও এখন দুর্লভ হয়ে গেছে। পাকিস্তান আমলে যে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প নগরী তৈরি করা হয়েছিল, তার বেশির ভাগই হয় বেদখল, না হয় অন্য কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। সরকারের উচিত প্রধান প্রধান শহরে এসএমইর জন্য আলাদা জমি বরাদ্দ। বিসিক শিল্পনগরীর মতো এসএমই শিল্পনগরী গড়ে উঠতে পারে। বিচ্ছিন্নভাবে এসব শিল্প গড়ে ওঠায় উদ্যোক্তারা নিরাপত্তাহীনতায় থাকেন। সন্ত্রাসীদের দ্বারা নারী উদ্যোক্তারা নানাভাবে হয়রানি ও চাঁদাবাজির শিকার হচ্ছেন বলে সম্প্রতি প্রথম আলোয় খবরও প্রকাশিত হয়েছে।

ঋণের জোগান বাড়ানোর পাশাপাশি এসএমই খাতের উদ্যোক্তাদের নিরাপত্তা দিতে পারলে এই খাতে আরও বেশি কর্মসংস্থান হবে।