এনআইডি জালিয়াতি

মানুষের ভোটের অধিকারের সুরক্ষা দিতে অসমর্থ নির্বাচন কমিশনের ভাবমূর্তি এমনিতেই বেশ মলিন। এখন তার সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েছে জাতীয় পরিচয়পত্র প্রকল্পের দুর্নীতি রোধ করতে না পারা। এমনকি বড় ধরনের দুর্নীতি যা চিহ্নিত হয়েছে, সে বিষয়ে দোষী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতেও তারা দুর্বলতার পরিচয় দিয়ে চলছে।

সুতরাং পরিচয়পত্রবিষয়ক শুধু দুর্নীতি রোধ বা জাল-জালিয়াতি বন্ধ করাই নয়, জাতীয় পরিচয়পত্র প্রকল্পের ব্যবস্থাপনাকে সম্পূর্ণ নতুন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে মূল্যায়ন করার সময় এসেছে। বিশেষ করে গত এক দশকের অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, নির্বাচন কমিশনকে একই সঙ্গে ভোটার তালিকা, জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি, বিতরণ এবং হালনাগাদকরণের দায়িত্ব পালন করতে হয়। ১৯৭২ সালের সংবিধান নির্দিষ্টভাবে কমিশনের জন্য ভোটার তালিকা তৈরির কাজই বরাদ্দ করেছিল। ২০১০ সালের জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন আইনের ৬ ধারা বলেছে, ইসি ‘জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন কার্যক্রম পরিচালনা, পরিচয়পত্র প্রস্তুতকরণ, বিতরণ ও রক্ষণাবেক্ষণসহ আনুষঙ্গিক সকল দায়িত্ব’ পালন করবে।

এখন সার্বিক বিষয় পর্যালোচনায় প্রতীয়মান হয় যে ভোটার তালিকা তৈরি এবং জাতীয় পরিচয় নিবন্ধনের পুরো দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের কাঁধে ন্যস্ত রাখাটা সমীচীন কি না, সেটা একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।

সমগ্র বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনার দাবি রাখে। এক বছরের বেশি সময় আগে চট্টগ্রামে অন্তত তিন হাজার আট শ রোহিঙ্গাকে ভুয়া এনআইডি সরবরাহের কেলেঙ্কারি উদ্‌ঘাটিত হয়। বিষয়টি বালিশ বা পর্দাকাণ্ডের মতো শুধু মামুলি আর্থিক দুর্নীতির বিষয় নয়; এর সঙ্গে জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্ন অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। দীর্ঘদিন ধরেই এনআইডি নিয়ে নানা মাত্রায় জাল-জালিয়াতির খবর গণমাধ্যমে আসছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে নির্বাচন কমিশন এখন পর্যন্ত যথেষ্ট কার্যকর বা যথাযথ পদক্ষেপ নিয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়নি। তাদের ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’ ধরনের মনোভাব নির্দেশ করছে যে তারা ব্যবস্থাপনাগত ব্যর্থতার দুঃখজনক নজির তৈরি করেছে।

তাই এখন নীতিনির্ধারকদের খতিয়ে দেখতে হবে, ভোটার তালিকা থেকে জাতীয় পরিচয় নিবন্ধনের দায়িত্বকে পৃথক করা সমীচীন কি না।

ভোট ও ভোটার হওয়ার সঙ্গে চলমান রাজনীতির একটা প্রত্যক্ষ যোগ থাকে। একদা এক কোটির বেশি ভুয়া ভোটার কমিশনের নেতৃত্বেই সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু ভোটার তালিকার গলদের থেকে পরিচয়পত্রের গলদ অনেক বেশি বিধ্বংসী। যেকোনো জাতির জীবনে তার নাগরিকদের স্মার্ট কার্ড অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও সংবেদনশীল। কারণ, জাতীয় পরিচয়পত্রের শুদ্ধতার ওপর নাগরিকের প্রাত্যহিক জীবনের, এমনকি প্রতি মুহূর্তের নির্বিঘ্ন জীবনযাপনের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক রয়েছে। বিষয়টি নিয়ে আমরা বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়েছি। কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ স্বীকার করেন, এই প্রকল্প যখন শুরু করা হয়েছিল, তখন ধরে নেওয়া হয়েছিল যে নির্বাচন কমিশন এই কাজে অব্যাহতভাবে বলিষ্ঠ নেতৃত্ব দিতে সক্ষম হবে। কিন্তু ইতিমধ্যে প্রমাণিত যে নিরঙ্কুশভাবে ইসির হাতে পরিচয়পত্র প্রকল্পটি রাখা আর নিরাপদ নয়। ২০০৮ সালে প্রকল্প শুরুর সময় আশা করা হয়েছিল, ২০১৬ সালের মধ্যে সাড়ে আট কোটি নাগরিকের হাতে তারা এনআইডি তুলে দিতে পারবে এবং আউটসোর্সিং-নির্ভরতা কাটিয়ে উঠতে পারবে। কিন্তু সেটা তারা পারেনি। অথচ আউটসোর্সিং বহাল রাখা মানেই আপনা-আপনি নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়া। নিরাপত্তার প্রতি নিত্যনতুন হুমকি তৈরি হওয়া।

উপরন্তু শূন্য বয়স থেকে ১৭ বছর বয়সী বাংলাদেশি নাগরিকদের এনআইডি দেওয়ার বিষয়টিও ভবিষ্যতে খুবই প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠবে। তখন ইসি নেতৃত্বের ওপর চাপ আরও বাড়বে। আমরা মনে করি, এনআইডি-বিষয়ক অনিয়মকে সর্বোচ্চ গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে এবং এসবের প্রতিরোধে শক্তিশালী আলাদা সংস্থা গড়ে তুলতে হবে। রাষ্ট্রের টাঁকশাল যে ধরনের সার্বক্ষণিক নজরদারিতে চলে, সেই মানের সংবেদনশীলতা ও যত্নে এনআইডির কার্যক্রম পরিচালনা নিশ্চিত করতে হবে।