করোনা নিয়ে সরকারের প্রজ্ঞাপন

সম্পাদকীয়

গতকাল রোববার সরকার ১৮ দফা নির্দেশনাসংবলিত একটি প্রজ্ঞাপন জারি করেছে, যা দেখে প্রতীয়মান হয়, কোভিড-১৯ মহামারির দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলা করার তাগিদ সরকারের নীতিনির্ধারক মহল এখন বেশ ভালোভাবেই উপলব্ধি করছে। সম্ভবত মনে করা হচ্ছে যে সংক্রমণের হার, রোগীর সংখ্যা, মৃত্যুর ঘটনা যেভাবে বেড়ে চলেছে, তাতে এখনই কঠোর পদক্ষেপ না নিলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। আজ থেকে আগামী এক সপ্তাহ দেশব্যাপী লকডাউনের ঘোষণাও সম্ভবত এই ভাবনার ফল। কিন্তু নির্দেশনা জারি করা এক কথা আর সেগুলো সাফল্যের সঙ্গে বাস্তবায়ন করা অন্য কথা। নির্দেশনা জারির সময়েই সব দিক বিবেচনায় নিয়ে ভেবে দেখা দরকার সেগুলো বাস্তবায়ন করা কতটা সম্ভব। বাস্তবায়ন করা অসম্ভব এবং জনসাধারণের জন্য সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে, এমন নির্দেশনা জারি করা উচিত নয়।

রোববারের প্রজ্ঞাপনে মোটাদাগে বলা হয়েছে আজ সকাল ৬টা থেকে ১১ এপ্রিল রাত ১২টা পর্যন্ত কী করা যাবে আর কী করা যাবে না। সরকারি-বেসরকারি অফিস-আদালত খোলা থাকবে, অর্থাৎ কর্মজীবী মানুষের কর্মস্থলে যাওয়ায় কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। কিন্তু সব ধরনের গণপরিবহন চলাচলে নিষেধাজ্ঞা আছে। তাহলে মানুষ কীভাবে কর্মস্থলে যাবেন? প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত অফিস-আদালতে কর্মরত ব্যক্তিরা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর নিজস্ব পরিবহনে কর্মস্থলে যাওয়া-আসা করবেন। বোঝা গেল, এই সব প্রতিষ্ঠানের সেই সামর্থ্য আছে, যদিও সামর্থ্যটা পর্যাপ্ত কি না, তা পরিষ্কার নয়। কিন্তু বেসরকারি শিল্পকারখানা, নির্মাণ প্রতিষ্ঠান ইত্যাদির শ্রমিকদের ‘নিজস্ব ব্যবস্থাপনায়’ আনা-নেওয়া করতে হবে—এই নির্দেশনা কতটা বাস্তবসম্মত? তৈরি পোশাকশিল্প খাতের সংগঠন বিজিএমইএ এবং বিকেএমইএর পক্ষে কি সরকারের এই নির্দেশনা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে?

অন্য দিকে সকাল আটটা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত সমস্ত কাঁচাবাজার খোলা থাকবে বলা হয়েছে; কিন্তু গণপরিবহন বন্ধ থাকলে মানুষ কীভাবে বাজারে আসা-যাওয়া করবে? পণ্য পরিবহনের জন্য পর্যাপ্তসংখ্যক যানবাহন কি চলাচল করতে পারবে? বাজারে পণ্য সরবরাহ কম হলে দাম বেড়ে যাবে, সেই আর্থিক চাপ পড়বে ভোক্তাসাধারণের ওপর। ব্যাংক ব্যবস্থা ‘সীমিত পরিসরে’ চালু থাকবে বলা হয়েছে; কিন্তু আর্থিক লেনদেনের জন্য মানুষ ব্যাংকে যাওয়া-আসা করবে কীভাবে? আরও বড় সমস্যার কথা হলো, যে বিপুলসংখ্যক মানুষ দৈনিক আয়ের ওপর নির্ভর করে বেঁচে থাকেন, এই সাত দিন তাঁরা চলবেন কীভাবে? তাঁদের শিশুদের খাদ্যসংকট দেখা দিলে সরকার কি তার দায়িত্ব নেবে? তাঁদের ঘরে ঘরে খাদ্য পৌঁছে দেবে?

প্রজ্ঞাপনটির নির্দেশনাগুলো লক্ষ করলে মনে হয়, এগুলোর লক্ষ্য প্রধানত শহর-নগরের মানুষ। কিন্তু ১৭ কোটি মানুষের বাংলাদেশের সিংহভাগ জনগোষ্ঠীই তো গ্রাম-মফস্বলে বাস করেন। গ্রামাঞ্চলে সর্বাধিক লোকসমাগম ঘটে হাটবাজারে। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, সব কাঁচাবাজার খোলা থাকবে, তাহলে গ্রামীণ হাটবাজারও কি খোলা থাকবে? সেগুলোতে সংক্রমণ ছড়ানোর ঝুঁকি মোকাবিলার জন্য কী নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে?

বস্তুত, গণপরিবহন বন্ধ করে দিলে অর্থনীতিসহ স্বাভাবিক জীবনপ্রবাহ থমকে যায়। প্রজ্ঞাপনে ‘লকডাউন’ শব্দটি ব্যবহার না করে যে ১৮ দফা নির্দেশনা জারি করা হয়েছে, সেগুলোর কোনটা কতখানি বাস্তবায়ন সম্ভব, তা বলা কঠিন। কিন্তু সংক্রমণ ও মৃত্যু বেড়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে হাত গুটিয়ে বসে থাকারও সুযোগ নেই। তাই সামগ্রিক জনস্বার্থে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য বিচক্ষণতা ও দূরদর্শিতা প্রয়োজন, যাতে কোনো সিদ্ধান্তের ফলে বিভ্রান্তি ও নতুন নতুন সমস্যার উদ্ভব না ঘটে, জনজীবনে দুর্ভোগ বাড়ে। সামাজিক ও শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা এবং কোভিড রোগীদের চিকিৎসাক্ষেত্রে সামগ্রিক ব্যবস্থাপনা আরও উন্নত করার মধ্য দিয়ে মহামারির দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলায় সবাইকে সচেষ্ট হতে হবে।