করোনাভাইরাসের এক বছর

সম্পাদকীয়

৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম করোনাভাইরাস সংক্রমণ শনাক্তের এক বছর পূর্ণ হলো। পরদিনের সংবাদমাধ্যমে খবর বেরোল, এই ভাইরাসে সংক্রমিত রোগীর সংখ্যা, সংক্রমণের হার ও মৃত্যুর ঘটনা—সবই আবার বাড়ছে। কিন্তু এর আগে প্রায় দুই মাস ধরে সংক্রমণ পরিস্থিতি অনেকটা নিয়ন্ত্রণে ছিল। ৬ মার্চ পর্যন্ত গড় সাপ্তাহিক সংক্রমণের হার ছিল ৩ দশমিক ৮৪ শতাংশ, কিন্তু ৯ মার্চের খবরে জানা গেল, সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় সংক্রমণের হার বেড়ে ৫ শতাংশে উঠেছে। ওই সময়ে মারা গেছেন ১৪ জন; অথচ ২৪ ঘণ্টায় মৃত্যুর সংখ্যা কমতে কমতে ৫-এর নিচে নেমেছিল। করোনাভাইরাসের সব সূচকের এই ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা যদি অব্যাহত থাকে, তাহলে তা অবশ্যই উদ্বেগের বিষয় হবে।

এক বছরে ৫ লাখ ৫১ হাজার ১৭৫ জনের কোভিড-১৯–এ আক্রান্ত হওয়া এবং ৮ হাজার ৪৭৬ জনের মৃত্যুর পরিসংখ্যান থেকে বলা যায়, আমরা বড় ট্র্যাজেডি এড়াতে পেরেছি। কারণ, অনেক দেশে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা আমাদের তুলনায় অনেক বেশি। আমরা এ পর্যন্ত সংক্রমণ মোকাবিলায় অন্য অনেক দেশের তুলনায় ভালো করেছি। সর্বশেষ অর্জনটি হলো, অনেক দেশের তুলনায় বেশ আগেভাগেই করোনাভাইরাসের টিকার সংস্থান আমরা করতে পেরেছি এবং দেশজুড়ে টিকাদান কর্মসূচি চলছে।

টিকাদান শুরুর এক মাস পেরোনোর পর সংক্রমণের হার আবার বাড়ছে—এতে টিকার কার্যকারিতা সম্পর্কে প্রশ্ন জাগতে পারে। অবশ্য বিশেষজ্ঞদের তরফ থেকে এ রকম প্রশ্ন এখনো ওঠেনি। কারণ, এখন পর্যন্ত টিকা গ্রহণ করেছেন খুবই কমসংখ্যক মানুষ, ৯৭ শতাংশ মানুষই টিকার বাইরে। তাহলে সংক্রমণ নতুন করে বাড়তে শুরু করার পেছনের কারণ কি হতে পারে এই যে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বিষয়টি এখন একেবারেই অবহেলিত হচ্ছে? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত না হলে পরিস্থিতি আবারও খারাপের দিকে যেতে পারে। মঙ্গলবার মন্ত্রিসভার বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও ‘আমরা যেন না ভাবি আমরা কমফোর্ট জোনে আছি’ বলে সতর্ক করেছেন এবং সবাইকে ‘অবশ্যই স্বাস্থ্যবিধি ঠিকমতো’ মেনে চলার নির্দেশনা দিয়েছেন।

আমরা যদি করোনাভাইরাস প্রথম সংক্রমণ শনাক্ত হওয়ার পরের এক বছরের অভিজ্ঞতার দিকে ফিরে তাকাই, তাহলে দেখি গত বছরের ৮ মার্চ প্রথম সংক্রমণ শনাক্ত হওয়ার পরের মাস দুয়েক সংক্রমণ তেমন বাড়েনি। সংক্রমণ শনাক্ত হওয়ার হার লক্ষণীয়ভাবে বাড়তে শুরু করে মে মাসের মাঝামাঝি থেকে এবং তা বাড়তে বাড়তে আগস্টের তৃতীয় সপ্তাহে সর্বোচ্চ মাত্রায় ওঠে। শনাক্ত রোগীর হার ওই সময় ২০ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, যেটাকে উদ্বেগজনক মাত্রার উচ্চ হার বলে মনে করা হয়। কিন্তু পরীক্ষার মাধ্যমে শনাক্ত রোগীর হিসাব থেকে সারা দেশে মোট সংক্রমিত ব্যক্তির সংখ্যা নিরূপণ করা সম্ভব ছিল না। কারণ, বিপুলসংখ্যক মানুষ পরীক্ষার বাইরে ছিলেন, যাঁরা সংক্রমিত হয়েছিলেন কিন্তু উপসর্গ প্রকাশ পায়নি।

আমরা দেখেছি, রোগীর সংখ্যা যখন খুব বেশি বেড়ে গিয়েছিল, তখন শুধু কোভিড রোগী চিকিৎসার ক্ষেত্রে নয়, নন-কোভিড সাধারণ রোগীদের চিকিৎসা ব্যবস্থাপনাও ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছিল। তাই এখন যখন আবার সংক্রমণের হার ও মৃত্যুর সংখ্যা বাড়তে শুরু করেছে, তখন আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার দিকে বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে। আর সংক্রমণ বৃদ্ধি ঠেকানোর জন্য চলমান টিকাদান কর্মসূচির আওতায় আরও বেশিসংখ্যক মানুষকে আনতে হবে। সাধারণ মানুষের মধ্যে টিকা গ্রহণে অনাগ্রহের যে খবর সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে, তা সত্য হলে এটা হবে নতুন করে সংক্রমণ বাড়ার প্রবণতা ঠেকানোর পথে একটা বড় চ্যালেঞ্জ। আর আমাদের অবশ্যই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ক্ষেত্রে বিদ্যমান শিথিলতা দূর করার জোরালো উদ্যোগ নিতে হবে।