করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন

সবার জন্য বিনা মূল্যে কোভিড–১৯–এর টিকা প্রদানের সিদ্ধান্তকে আমরা স্বাগত জানাই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদের গত অধিবেশনে বলেছিলেন, টিকার জন্য বাজেটে টাকা রাখা আছে। এখন নির্দিষ্টভাবে জানা গেল, বাংলাদেশ এ জন্য বিশ্বব্যাংকের কাছে দুই বিলিয়ন ডলারের ঋণও চাইবে। সুতরাং, অর্থায়নের হয়তো সমস্যা হবে না; তবে চ্যালেঞ্জ হলো বাস্তবে সব মানুষের টিকা পাওয়া এবং সে জন্য সুব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা।

টিকা সংগ্রহের বিষয়ে আমাদের সরকারের অবস্থান উন্মুক্ত। যেকোনো উৎস থেকেই টিকা সংগ্রহ করা হবে বলা হয়েছে। টিকার উৎস, ব্যবস্থাপনা ও ভোক্তা—এ তিনের মধ্যে সমন্বয় সাধনই হবে মুখ্য চ্যালেঞ্জ। তবে টাকা থাকলেই যথাসময়ে উপযুক্ত টিকা এবং তার পর্যাপ্ত সরবরাহ বিশ্বের অনেক রাষ্ট্রই আশা করতে পারে না। তাই বাংলাদেশকে পর্যাপ্ত অর্থ হাতে নিয়ে সর্বাত্মক টিকা কূটনীতিতে লেগে থাকতে হবে। ধরে নেওয়া ভালো, বিশ্বে সাধারণভাবে গ্রহণযোগ্য টিকা উৎপাদন হওয়ামাত্রই তা সহজলভ্য হবে না। বিশ্বের অনেক দেশ তাই অগ্রিম টাকা দিয়ে রাখছে। আমাদেরও তা করতে হতে পারে কি না এবং ঋণ করে আনা টাকা আমরা টিকা কেনার জন্য অগ্রিম পরিশোধ করতে পারি কি না, পারলে কাদের সে টাকা দেওয়া হবে—এসব বিষয়ে বিচক্ষণতা ও সুবিবেচনা দরকার।

চীনের টিকা নিয়ে সম্ভবত একটি সাময়িক অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। এ বিষয়ে সরকার নিশ্চয় সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হবে। ভারত টিকার যে সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছে, বাংলাদেশ তাকে সংগত কারণেই স্বাগত জানিয়েছে। তবে ভারতের যদি নিজস্ব টিকা হয়, তাহলে সেটা ভিন্ন কথা। যদি সেটা অক্সফোর্ডের টিকা হয়, তাহলে অক্সফোর্ডের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত হওয়ার চেষ্টা করাই হয়তো যুক্তিসংগত হবে।

টিকা পাওয়ার পরে টিকাদান কর্মসূচিকে সফল করার বিষয়ে আমরা আশাবাদী হতে পারি। কারণ, অন্যান্য সংক্রামক ব্যাধির টিকাদান কর্মসূচিতে আমাদের সাফল্যের রেকর্ড বেশ ভালো। অনেক দেশই এ ক্ষেত্রে এতটা সাফল্য অর্জন করতে পারেনি। এবারের চ্যালেঞ্জ হলো সেই সাফল্যের ধারাবাহিকতা বজায় রাখা। এ জন্য যাতে ব্যবস্থাপনায় সমস্যা না হয়, সে জন্য এখনই প্রস্তুতি নেওয়ার শুরু করা প্রয়োজন। প্রয়োজনীয় লোকবল, তাদের সামর্থ্য ও দক্ষতা তৈরির জন্য প্রশিক্ষণ, প্রয়োজনীয় অবকাঠামো গড়ে তোলা কিংবা বিন্যাস করা দরকার। টিকা সংরক্ষণের সুব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে, যেন সংরক্ষণকালে টিকার গুণগত মান নষ্ট বা ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। দেশের সব এলাকায় নিরবচ্ছিন্নভাবে বিদ্যুৎ থাকে না, শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থারও ঘাটতি থাকতে পারে—এসব দিকে বিশেষ নজর রাখতে হবে।

মনে রাখা প্রয়োজন, বর্তমানে চলমান জাতীয় টিকাদান কর্মসূচির তুলনায় অনেক বড় হবে করোনাভাইরাসের টিকাদান কর্মসূচি। দেশের প্রতিটি মানুষকেই এ টিকার আওতায় আনতে হবে; অর্থাৎ এটা প্রায় ১৭ কোটি টিকা সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও মানুষের দেহে প্রয়োগের মতো বিশাল এক কর্মযজ্ঞ। তবে যেসব ব্যক্তি কোভিডে আক্রান্ত হয়ে সেরে উঠেছেন, অ্যান্টিবডি গড়ে ওঠার কারণে তাঁদের করোনাভাইরাসের টিকা দিতে হবে না, দিলে তা হবে অপচয়—এমন কথাও বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ বলছেন। কিন্তু সেটা দেখার জন্য অ্যান্টিবডি পরীক্ষার প্রয়োজন হবে। এটাও একটা ভেবে দেখার বিষয়।

করোনাভাইরাসের টিকা সংগ্রহ করা থেকে শুরু করে বিনা মূল্যে প্রতিটি মানুষের দেহে তা প্রয়োগ করা পর্যন্ত সমগ্র প্রক্রিয়ার প্রতিটি ধাপ সুষ্ঠভাবে সম্পন্ন করার জন্য প্রয়োজনীয় লোকবল ও অবকাঠামো নিশ্চিত করার পাশাপাশি এ বিশাল কর্মসূচি বাস্তবায়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবার আন্তরিক দায়িত্বশীলতা একান্তভাবে প্রয়োজন হবে। সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করার বিষয়টিও বিবেচনায় রাখতে হবে।