করোনার টিকাদান

সম্পাদকীয়

করোনাভাইরাসের বহুপ্রতীক্ষিত টিকা অবশেষে যখন বাংলাদেশে চলে এসেছে, তখন দেখা যাচ্ছে মানুষের দেহে এ টিকা প্রয়োগের প্রাথমিক পদক্ষেপেই জটিলতা আছে। প্রথমেই প্রয়োজন অগ্রাধিকারভিত্তিক টিকা গ্রহণকারীদের তালিকা তৈরি করা। কিন্তু এ কাজ এখনো সম্পন্ন করা হয়নি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর প্রতিটি জেলার সিভিল সার্জনদের টিকা গ্রহণকারীদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করার নির্দেশ দিয়েছিল। সব জেলার সিভিল সার্জনের অফিস এ কাজে সফল হয়নি। ফলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এ উদ্যোগ বাদ দিয়ে টিকা গ্রহণকারীদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের দায়িত্ব দিয়েছে জেলা প্রশাসক, সিটি করপোরেশন বা পৌরসভার মেয়র এবং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের।

জেলা প্রশাসকেরা প্রতিটি জেলার করোনা টিকা প্রয়োগ কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। টিকা দেওয়া শুরু করতে হলে টিকা গ্রহণকারীদের তালিকা তাঁদেরই সবার আগে প্রয়োজন। কিন্তু প্রথম আলোর প্রতিনিধিরা খোঁজ নিয়ে জেনেছেন, ২২ জানুয়ারি পর্যন্ত সব জেলা প্রশাসকের কাছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের চিঠি পৌঁছায়নি। অথচ জরুরি ভিত্তিতে চিঠি পাঠানো হয়েছে ১৩ জানুয়ারি; অর্থাৎ প্রায় ৯ দিন আগে। একজন জেলা প্রশাসক বলেছেন, করোনার বিষয়ে জেলা প্রশাসন কাজ করছে সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশ অনুযায়ী। তাঁরা তালিকা তৈরির কোনো নির্দেশনা পাননি। এ থেকে মনে হয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কাজে সমন্বয়ের ঘাটতি রয়েছে।

অন্যদিকে টিকা গ্রহণকারীদের নিবন্ধনভুক্ত হওয়ার জন্য একটি সফটওয়্যার অ্যাপ্লিকেশন (অ্যাপ) তৈরি করা হয়েছে এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিভাগ থেকে বলা হয়েছে যে টিকা নিতে হলে ওই অ্যাপের সাহায্যে অনলাইনে নিবন্ধন করতে হবে। নাগরিক মহলে এ অ্যাপের কার্যকারিতার বিষয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কেউ কেউ বলেছেন, বাংলাদেশের আর্থসামাজিক বাস্তবতায় অনেক মানুষের পক্ষে এ অ্যাপ ব্যবহার করে টিকার জন্য নিবন্ধিত হওয়া সম্ভব নয়। আমাদেরও মনে হয়, গ্রামাঞ্চলে শিক্ষাবঞ্চিত ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে অ্যাপ কার্যকর হবে না। তবে সরকার প্রথমেই টিকা দেওয়ার জন্য অগ্রাধিকার ভিত্তিতে যে ১৫টি জনগোষ্ঠীর তালিকা তৈরি করেছে, তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ পেশাজীবী হওয়ায় তাদের ক্ষেত্রে অ্যাপটি কার্যকর হতে পারে। অবশ্য সে জন্য অ্যাপটির উন্নত মান নিশ্চিত করতে হবে, যেন মুঠোফোনসহ ইন্টারনেট–সংযুক্ত যেকোনো ডিজিটাল যন্ত্রে ওই অ্যাপের সাহায্যে সবার জন্য খুব সহজেই নিবন্ধন করা সম্ভব হয়। অবশ্য এভাবে সীমিতসংখ্যক মানুষকে টিকা দেওয়া যাবে। পর্যায়ক্রমে ১৭ কোটি মানুষের টিকা প্রয়োগের কাজ সুসম্পন্ন করতে হলে যে বিশাল তালিকা তৈরি করতে হবে, তার প্রধান ভিত্তি হওয়া উচিত জাতীয় পরিচয়পত্র।

করোনার টিকা প্রয়োগ এক বিশাল কর্মযজ্ঞ। টিকা গ্রহণকারীদের তালিকা তৈরি করা এর প্রাথমিক পদক্ষেপ। টিকা যখন পৌঁছে গেছে, তখনো আমরা প্রাথমিক পদক্ষেপই সম্পন্ন করতে পারিনি, এটা দুঃখজনক। এ অবস্থায় ২৭ জানুয়ারি টিকা দেওয়া শুরু হতে যাচ্ছে। সুতরাং অবিলম্বে তালিকা তৈরির গতি বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে। সেই সঙ্গে টিকা প্রয়োগের জন্য পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত লোকবল নিশ্চিত করতে হবে। যথাযথ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে টিকা সংরক্ষণ, পরিবহন ও প্রয়োগ করা হচ্ছে কি না, সেদিকেও সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে।