করোনার দুর্বোধ্য গতিপ্রকৃতি

কোভিড-১৯ মহামারির গতিপ্রকৃতির দুর্বোধ্যতা কাটছে না। শীতকালের শুরুতে সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ আসার আশঙ্কা আমাদের দেশে সত্য প্রমাণিত হয়নি। বরং শীতের শেষে সংক্রমণ আবার ধীরে ধীরে বাড়তে শুরু করেছে। সর্বশেষ পরিস্থিতি নতুন করে উদ্বেগ সঞ্চার করছে। কারণ, পরীক্ষার মাধ্যমে শনাক্ত সংক্রমণের হার, হাসপাতালে রোগীর সংখ্যা এবং মৃত্যুর ঘটনা—সবই ক্রমান্বয়ে আবার বাড়ছে। যে দেশে দৈনিক শনাক্ত রোগীর হার কমতে কমতে ৩ শতাংশের নিচে নেমেছিল, সেখানে তা আবার বাড়তে বাড়তে ১০ শতাংশের কাছাকাছি উঠেছে এবং এ ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা অব্যাহত আছে। করোনায় প্রতি ২৪ ঘণ্টায় মৃত্যু নেমে গিয়েছিল ৫-এর নিচে, কিন্তু কয়েক দিন ধরে প্রতি ২৪ ঘণ্টায় মারা যাচ্ছেন ২০ জনের বেশি রোগী।

সর্বশেষ খবরে জানা গেল, হাসপাতালগুলোতে হঠাৎ করে কোভিড রোগীর সংখ্যা বাড়তে শুরু করায় চিকিৎসাক্ষেত্রে চাপ সৃষ্টি হয়েছে। অথচ সংক্রমণের উচ্চ হারের সময়েও দেশের কোভিড হাসপাতালগুলোর অনেক শয্যা খালি পড়ে থাকত। আইসিইউ সুবিধাসংবলিত শয্যাগুলোরও একটা বড় অংশে রোগী থাকত না। এখন দেখা যাচ্ছে, আইসিইউ সেবার প্রয়োজন হচ্ছে, এমন রোগীর সংখ্যাও দ্রুত বাড়ছে। রাজধানীর কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের কর্তৃপক্ষ প্রথম আলোকে জানিয়েছে, কয়েক দিন ধরে করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হয়ে যেসব রোগী সেখানে যাচ্ছেন, তাঁদের অনেকেই তীব্র শ্বাসকষ্টে ভুগছেন।

একটা সময়ে সংক্রমণের তুলনায় মৃত্যুর হার বেশ কম ছিল, কিন্তু একটা সময় এসেছিল, যখন সংক্রমণ কম হলেও মৃত্যুর ঘটনা বাড়ছিল। এ থেকে অনেক বিশেষজ্ঞ আশঙ্কা করছেন, এখন যাঁরা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছেন, তাঁদের মৃত্যুর ঝুঁকি সম্ভবত আগের তুলনায় বেড়েছে। এর একটা কারণ হতে পারে, করোনাভাইরাসের রূপান্তর ঘটেছে এবং তা আরও শক্তিশালী হচ্ছে। আর একটি কারণ হতে পারে এই যে একাধিক নতুন স্ট্রেইন বা ধরনের করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে এবং পড়ছে। ইতিমধ্যে দক্ষিণ আফ্রিকার স্ট্রেইন বা ধরনের করোনাভাইরাস বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে, যার ক্ষেত্রে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা কার্যকর নয় বলে বলা হচ্ছে। লন্ডনের ধরনের করোনাভাইরাসও বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে, যার সংক্রমণক্ষমতা খুব বেশি। অর্থাৎ, নতুন নতুন ধরনের করোনাভাইরাসের প্রবেশ কিংবা ইতিমধ্যে ক্রিয়াশীল করোনাভাইরাসের সম্ভাব্য মিউটেশন বা রূপান্তর আমাদের মহামারি মোকাবিলার সামগ্রিক চ্যালেঞ্জকে তীব্রতর করে তুলতে পারে।

দুঃখের বিষয়, চলমান মহামারি মোকাবিলার সরকারি উদ্যোগ ইতিমধ্যে শিথিল হয়ে পড়েছে। সরকারি কর্মকাণ্ড সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে কোভিড রোগীদের চিকিৎসা, নমুনা সংগ্রহ, শনাক্তকরণ পরীক্ষা চালানো এবং টিকাদান কর্মসূচির মধ্যে। টিকার ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, এ কর্মসূচি এখন পর্যন্ত সীমাবদ্ধ রয়ে গেছে মূলত শিক্ষিত, শহুরে, মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের মধ্যে। সত্যিকার অর্থে গণটিকাদান কার্যক্রম এখন পর্যন্ত শুরু হতে পারেনি। এর মূল কারণ টিকা গ্রহণে সাধারণ মানুষের অনাগ্রহ বা উৎসাহহীনতা। টিকার কার্যকারিতা নিয়ে সংশয় কেটে গিয়ে থাকলে টিকা গ্রহণে উৎসাহ বাড়ার কথা; কিন্তু টিকা গ্রহণের জন্য নিবন্ধন ও টিকা প্রয়োগের পরিসংখ্যান থেকে টিকা গ্রহণে উৎসাহ বাড়ার প্রমাণ এখনো মিলছে না।

পরিস্থিতি আরও খারাপ হওয়ার আগেই আমাদের কয়েকটি বিষয়ের ওপর বিশেষ জোর দিতে হবে। প্রথমত, টিকা গ্রহণের জন্য সর্বসাধারণকে উৎসাহিত করার ব্যাপক উদ্যোগ নিতে হবে। সরকারি-বেসরকারি সব পর্যায়ে টিকা গ্রহণের পক্ষে প্রচার বাড়াতে হবে। দ্বিতীয়ত স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ক্ষেত্রে যে শিথিলতা চলছে, তা অবশ্যই দূর করতে হবে। এ জন্য এখন কঠোর পদক্ষেপ জরুরি হয়ে উঠেছে। তৃতীয়ত, বিদেশ থেকে যাঁরা আসছেন, তাঁদের প্রত্যেককেই প্রাতিষ্ঠানিক, পারিবারিক এবং ব্যক্তিগত উদ্যোগে অন্তত ১৪ দিন বিচ্ছিন্ন থাকতে হবে, যাতে ভাইরাসের নতুন নতুন ধরন এ দেশে প্রবেশ করতে না পারে।