করোনায় মৃত্যু কেন বাড়ছে

বাংলাদেশে প্রতি ২৪ ঘণ্টার হিসাবে শনাক্ত করোনা রোগীর হার কমছে—এ তথ্যের বিপরীত তথ্য হলো এ রোগে মানুষের মৃত্যু বাড়ছে। সর্বশেষ পরপর ছয় দিন প্রতি ২৪ ঘণ্টায় গড়ে ৪০ জনের বেশি করোনা রোগী মারা গেছেন। শুক্রবার পাওয়া হিসাবে আগের ২৪ ঘণ্টায় মারা গেছেন ৪৭ জন। তার আগের ২৪ ঘণ্টায় মৃত্যুর সংখ্যা ৪৫ জন। ২৬ আগস্ট পাওয়া সংখ্যাটি ছিল ৫৪। প্রশ্ন হলো সরকারের ভাষ্য অনুযায়ী, দেশে করোনা সংক্রমণ যখন কমছে, তখন এ রোগে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে কেন?

এ প্রশ্নের আংশিক উত্তর পাওয়া যায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলমের একটি বক্তব্যে। গত শুক্রবার তিনি প্রথম আলোকে বলেন, করোনায় ‘মৃত্যু কমানোর সুনির্দিষ্টভাবে কোনো উদ্যোগ না থাকলেও রোগী চিকিৎসার বিষয়ে কোনো ঘাটতি নেই।’ তাঁর এ বাক্যের প্রথম অংশে এটা স্পষ্ট, করোনায় মৃত্যু কমানোর লক্ষ্যে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সুনির্দিষ্ট কোনো উদ্যোগ নেয়নি। কিন্তু পাবলিক হেলথ অ্যাডভাইজারি কমিটি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে করোনায় মৃত্যু কমানোর লক্ষ্যে সুনির্দিষ্ট উদ্যোগ নিতে পরামর্শ দিয়ে একটি লিখিত রূপরেখা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে জমা দিয়েছিল। কিন্তু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বা অধিদপ্তর সে রকম কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। আর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক যে বললেন, করোনা রোগী চিকিৎসার বিষয়ে কোনো ঘাটতি নেই—তাঁর এ দাবির সারবত্তা কোথায়?

প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশে করোনা রোগীদের চিকিৎসার অবস্থা হতাশাব্যঞ্জক। সে কারণেই মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়েও চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে ভর্তি হতে আগ্রহ বোধ করছেন না। সারা দেশে কোভিড হাসপাতালগুলোর মোট শয্যার সংখ্যা ১৪ হাজার ৮৪৩। এগুলোর মধ্যে ১১ হাজার ৪৫টি শয্যাই খালি পড়ে আছে। এর অর্থ এই যে কোভিড হাসপাতালগুলোর চিকিৎসার ওপর মানুষ যথেষ্ট আস্থা পাচ্ছেন না। হাসপাতালের ওপর রোগীদের আস্থা কমে যাওয়ার ঘটনা পৃথিবীতে বিরল। আর বাংলাদেশের মতো রোগীবহুল দেশে, যেখানে কোনো হাসপাতালেই কখনো রোগীর স্থান সংকুলান হয় না বলে মেঝেতে, করিডরে, সিঁড়ির কোনায় রোগীদের আশ্রয় নিতে হয়; সেই দেশে কী কারণে প্রায় ১৫ হাজার শয্যার মধ্যে ১১ হাজারের বেশি শয্যা খালি পড়ে থাকতে পারে—এ প্রশ্ন কি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের কর্তাব্যক্তিদের ভাবিত করে? পাবলিক হেলথ অ্যাডভাইজারি কমিটির অন্যতম সদস্য ও জনস্বাস্থ্যবিশারদ আবু জামিল ফয়সাল প্রথম আলোর কাছে মন্তব্য করেছেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় করোনায় মৃত্যুর বিষয়টিকে গুরুত্ব দিচ্ছে না। গুরুত্ব দিলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর মৃত্যু কমানোর উদ্যোগ নিত।

করোনায় মৃত্যু কমানোর উদ্যোগ অবশ্যই নিতে হবে। সে জন্য পাবলিক হেলথ অ্যাডভাইজারি কমিটির লিখিত রূপরেখাটির বাস্তবায়ন জরুরি। আর কোভিড হাসপাতালগুলোতে রোগীদের ভর্তি ও মৃত্যুর ঘটনাগুলোর পর্যালোচনা থেকে দেখা যাচ্ছে, হাসপাতালে ভর্তি করোনা রোগীদের মৃত্যুর একটি বড় কারণ তঁাদের দেরিতে ভর্তি হওয়া। যেমন ঢাকার মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৯৩ জন করোনা রোগীর মৃত্যুর ঘটনায় দেখা গেছে, হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার প্রথম দুই ঘণ্টার মধ্যেই মৃত্যু হয়েছে ১১ জনের, প্রথম ২৪ ঘণ্টায় মারা গেছেন ২২ জন; প্রথম ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে মারা গেছেন ১২ জন। অর্থাৎ, বেশ বড়সংখ্যক করোনা রোগী হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন শেষ সময়ে, যখন তাঁদের অবস্থা গুরুতর। এরও একটি কারণ হাসপাতালের ওপর মানুষের আস্থার অভাব। তাঁরা বাসায় থেকেই চিকিৎসা নেওয়ার সর্বাত্মক চেষ্টা করেও যখন দেখছেন রোগীর অবস্থা জটিল, তখন অগত্যা হাসপাতালে যাচ্ছেন। এ পরিস্থিতির উত্তরণ দরকার। করোনা রোগীদের হাসপাতালমুখী করার জন্য হাসপাতালে চিকিৎসাব্যবস্থা উন্নত করে আস্থা ফেরানোর উদ্যোগ নিতে হবে।