কারাগারের নিরাপত্তা ও পরিবেশ

গত মার্চে জাতীয় সংসদে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, দেশের কারাগারগুলোতে বন্দী ধারণক্ষমতা ৪০ হাজার। কিন্তু আছেন ৮৮ হাজার ৮৪ জন বন্দী, যা দ্বিগুণের বেশি। তবে কারাগারের নানা অনিয়ম-দুর্নীতি ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের জন্য বন্দীদের আধিক্যই একমাত্র কারণ নয়। কারাগারের নিরাপত্তায় নিয়োজিত ব্যক্তিদের দায়িত্বে অবহেলা, দুর্নীতি ও জবরদস্তির কারণে সেখানে যে পরিবেশ তৈরি হয়, তাতে অনেক বন্দী সংশোধিত না হয়ে আরও বেশি অপরাধের সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়েন।

সম্প্রতি একটি মামলার সূত্রে উচ্চ আদালত কারাগারের পরিবেশ উন্নয়নের লক্ষ্যে যে আট দফা নির্দেশনা দিয়েছেন, তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিচারপতি নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি আহমেদ সোহেলের নেতৃত্বাধীন হাইকোর্ট বেঞ্চের দেওয়া নির্দেশনার মধ্যে আছে কারাগারের ভেতরে নিরাপত্তা, শান্তি ও শৃঙ্খলা বজায় রাখা, বাইরে থেকে যাতে কারাগারে মাদকদ্রব্য ঢুকতে না পারে, সে বিষয়েও কঠোরতা অবলম্বন ইত্যাদি। আদালত বলেছেন, হলফনামার নামে যাতে কেউ জালিয়াতি না করতে পারে, সে বিষয়ে কারা কর্তৃপক্ষকে সজাগ থাকতে হবে। প্রধান কারা পরিদর্শক, কারাপ্রধান, উপ–কারাপ্রধানের দপ্তরে দণ্ডিত ও বিচারাধীন বন্দীদের পুরো নাম-ঠিকানাসহ কারাগারে প্রবেশের ও মামলার তারিখ লিখে রাখতে হবে।

৫ কোটি ৪৪ লাখ টাকার দুর্নীতিসংক্রান্ত একটি মামলার অভিযুক্ত বন্দী মিজানুর রহমান ওরফে কনকের জামিনের আবেদন পরীক্ষা করে আদালত দেখতে পান, তিনি চলতি বছরের ১৫ জুন ভার্চ্যুয়াল আদালত থেকে জামিন নিয়ে ২৫ জুন কারামুক্ত হয়েছেন। কিন্তু ১১ অক্টোবর কেরানীগঞ্জ কারাগারের উপপ্রধান খোন্দকার আল মামুনের মাধ্যমে ফের জামিনের আবেদন করেছেন। এরপর উপকারাপ্রধান আদালতে হাজির হয়ে ভুল স্বীকার করলে আদালত তাঁকে ক্ষমা করে দেন। অন্যদিকে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে নিম্ন আদালতে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেওয়া হয়।

বিভিন্ন কারাগারে জমজমাট মাদক ব্যবসার অভিযোগ আছে। কোনো কোনো কারাগারে এ নিয়ে খুন-জখমের ঘটনাও ঘটছে। বাইরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের অগোচরে মাদক ব্যবসা চলতে পারে, কিন্তু কারাগারের ভেতরে তা সম্ভব নয়। বন্দীদের কোনো দর্শনার্থী মাদক নিয়ে গেলে তা তল্লাশি ও জব্দ করার দায়িত্ব রক্ষীদের। আদালতের নির্দেশনা মেনে চললে কারাগারের ভেতরে যেমন খুন-জখমের ঘটনা ঘটবে না, তেমনি সেখানকার পরিবেশও সহনীয় হবে।

কারাগার হলো অপরাধীদের সংশোধনাগার। এখানে যাঁরা বন্দী থাকেন, হোক দণ্ডিত বা বিচারাধীন, তাঁদের এমন পরিবেশে রাখা প্রয়োজন, যেখানে নিজেদের সংশোধন করার সুযোগ পাবেন। ভারতে কিরণ বেদি নামের একজন কারাপরিদর্শক দিল্লির তিহার জেলে এমন পরিবেশ তৈরি করেছিলেন, যেখানে বন্দীরা অনেকটা ‘মুক্ত’ জীবন যাপন করতেন। চার দেয়ালের ভেতরই তিনি বন্দীদের উন্নত জীবন গড়া, তথা পড়াশোনা ও নির্মল বিনোদনের সুযোগ তৈরি করেছিলেন। বাংলাদেশের কারাগারে সে রকমটি আশা করা বাহুল্য হলেও কর্তৃপক্ষ অন্তত কারা আইন মেনে চলুক, বন্দীদের মাদক ও অন্যান্য অপরাধ থেকে দূরে রাখুক। তাহলে সংশোধনাগারকে অন্তত কেউ অপরাধের স্বর্গ ভাববে না।