কোভিডের উপসর্গে মৃত্যু

কোভিড–১৯ মহামারির ছয় মাসে বাংলাদেশে এ রোগে মোট মৃত্যুর সংখ্যা সরকারি হিসাবে ৪ হাজার ৬৬৮ আর সর্দি–কাশি, গলাব্যথা, কাশি, শ্বাসকষ্ট—এসবে ভুগে মারা গেছেন ২ হাজার ১৮০ জন। এসব উপসর্গ কোভিডের প্রধান উপসর্গগুলোর মতো, তাই সংবাদমাধ্যমে এসব মৃত্যু বর্ণিত হচ্ছে কোভিডের বা করোনার উপসর্গে মৃত্যু বলে। উভয় ধরনের মৃত্যুর খবরই দেশের সংবাদমাধ্যমে সমান্তরালভাবে প্রকাশিত হয়ে চলেছে। তবে কোভিড–১৯ আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত রোগীদের মৃত্যুর বিষয়টি সরকারি মহলে যতটা গুরুত্ব পাচ্ছে, কোভিডের উপসর্গে ভোগা মানুষের মৃত্যুর বিষয়টি ততটা গুরুত্ব পাচ্ছে না। কিন্তু উভয় প্রকার মৃত্যুই সমান বেদনাদায়ক। সরকারের উচিত উভয় সমস্যা সমান গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা।

কোভিড–১৯–এর উপসর্গ নিয়ে যাঁরা মারা গেছেন, তাঁদের মধ্যে কোভিড–১৯ আক্রান্ত রোগী ছিলেন কি না, থাকলে তাঁদের সংখ্যা কত—এ বিষয়ে নিশ্চিতভাবে কিছু বলা সম্ভব নয়। কারণ, তাঁদের কোভিড–১৯ শনাক্তকরণ পরীক্ষা করা হয়নি। পরীক্ষা করা হলে বিষয়টি সম্পর্কে জানা যেত এবং সেটা বাংলাদেশে কোভিডে মৃত্যুর প্রকৃত চিত্র পাওয়ার ক্ষেত্রে সহায়ক হতো। কিন্তু স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কোভিড–১৯ মোকাবিলা কার্যক্রমে কোভিডের উপসর্গ নিয়ে মৃত্যুর বিষয়টির উল্লেখ পাওয়া যায় না। এ বিষয়ে পাওয়া তথ্যের ভিত্তি দেশের সংবাদমাধ্যম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘বাংলাদেশ পিস অবজারভেটরি’ দেশের ২৫টি সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবরাখবর বিশ্লেষণ করে এ তথ্য দিয়েছে। তাদের বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, এসব উপসর্গে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মানুষের মৃত্যু ঘটেছে চট্টগ্রাম বিভাগে, সংখ্যাটি ৭২৮। আর ঢাকা বিভাগে এসব উপসর্গে মারা গেছেন ৩৯৩ জন। ঢাকা বিভাগের চেয়ে চট্টগ্রাম বিভাগের সংখ্যাটি দ্বিগুণের কাছাকাছি হওয়ার বিষয়টি কৌতূহলোদ্দীপক: এর কি কোনো বিশেষ কারণ থাকতে পারে?

কোভিডের পাশাপাশি এখন সাধারণ সর্দিজ্বর বা ইনফ্লুয়েঞ্জারও মৌসুম। তবে এ দেশে ইনফ্লুয়েঞ্জায় ৬ মাসে ২ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু স্বাভাবিক না অস্বাভাবিক, তা বুঝতে হলে কোভিড আসার আগের অন্য বছরগুলোর পরিসংখ্যানের দিকে তাকানো প্রয়োজন। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে এ সম্পর্কে কোনো তথ্য বা হিসাব নেই। বস্তুত, সর্দিজ্বর বা ইনফ্লুয়েঞ্জা শুধু নয়, বাংলাদেশে অনেক রোগেই মানুষের মৃত্যুর হিসাব নথিভুক্ত করে সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেই। শিশুমৃত্যু, মাতৃ বা প্রসূতির মৃত্যু, কিডনি রোগ, ক্যানসার—এ ধরনের কিছু মৃত্যুর অনুমিত হিসাব পাওয়া যায়। তা ছাড়া কয়েক বছর ধরে ডেঙ্গু জ্বরে মৃত্যুর হিসাব রাখা হচ্ছে। কোভিড মহামারির এই সময়ে একই ধরনের উপসর্গে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মানুষের মৃত্যুর বিষয়টি লক্ষ করে এমন তাগিদ অনুভূত হচ্ছে যে কোন রোগে বছরে কত মানুষের মৃত্যু ঘটে, তার হিসাব রাখা উচিত। তাহলে দেশের স্বাস্থ্য পরিস্থিতি সম্পর্কে সঠিক ধারণা পাওয়া এবং তার ভিত্তিতে করণীয় নির্ধারণ করা সহজ হয়।

বাংলাদেশে রোগী হাসপাতালে ভর্তি না হলে, বাসায় থেকে মৃত্যুবরণ করলে সরকারি নথিতে সেই মৃত্যুর হিসাব যুক্ত হয় না। আবার হাসপাতালগুলোতে বছরে কোন রোগে কত মানুষ মারা যায়, তার হিসাব বিচ্ছিন্নভাবে থাকলেও সব হাসপাতালের তথ্য সন্নিবেশ করে সামগ্রিক পরিসংখ্যান তৈরির সংস্কৃতিও চালু হয়নি। তা ছাড়া বেসরকারি হাসপাতালগুলো সারা বছরের রোগী মৃত্যুর সঠিক হিসাব পদ্ধতিগতভাবে সংরক্ষণ করে কি না, সেটাও দেখা প্রয়োজন। সব মিলিয়ে আমাদের মনে হয়, রোগভিত্তিক মৃত্যুর পরিসংখ্যান তৈরি করা এবং তা যথাযথভাবে সংরক্ষণের প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।

আর চলমান কোভিড–১৯ মহামারিতে সামনের দিনগুলোতে যেসব মানুষ একই রকম উপসর্গে মারা যাবেন, তাঁদের প্রত্যেকের কোভিড শনাক্তকরণ পরীক্ষা করা উচিত। এটা মহামারির প্রকৃত চিত্র পেতে সহায়ক হবে এবং সর্দিজ্বর বা ইনফ্লুয়েঞ্জার প্রাণঘাতী বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আরও ধারণা পাওয়া যাবে।