যখন ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো রমরমা ব্যবসা করছিল, তখন মন্ত্রী-কর্মকর্তারা এর পক্ষে জোর প্রচার চালিয়েছেন, এর ভালো-মন্দ বিচার করেননি। হালে ই-কমার্সের নামে ক্রেতাদের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করার ঘটনা ফাঁস হয়ে যাওয়ার পর তাঁরা নিশ্চুপ। এমনকি তদারকি প্রতিষ্ঠানগুলোও এর দায় নিতে চাইছে না।
যেকোনো ব্যবসা, সেটি সরাসরি হোক কিংবা অনলাইনভিত্তিক—নির্দিষ্ট আইন ও বিধিমালার অধীনে চলে। কেউ সেই আইন ভঙ্গ করলে কিংবা ক্রেতাসাধারণের স্বার্থহানি করলে সরকারেরই উচিত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া। যে ১২টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে গ্রাহকদের সঙ্গে প্রতারণা করার অভিযোগ পাওয়া গেছে (কোনো কোনোটি ইতিমধ্যে প্রমাণিত) সেগুলো হলো ইভ্যালি, ই-অরেঞ্জ, ধামাকা, নিরাপদ ডটকম ও এসপিসি ওয়ার্ল্ড আলেশা মার্ট, কিউকম, দালাল প্লাস, আদিয়ান মার্ট, সিরাজগঞ্জ শপ, আলাদিনের প্রদীপ ও প্রিয় শপ।
এই ১২ প্রতিষ্ঠানের কাছে সব মিলিয়ে গ্রাহক ও সরবরাহকারীদের পাওনা কত, তার কোনো হিসাব নেই। তবে পুলিশ, র্যাব, গ্রাহক ও মালিকপক্ষের দাবি অনুযায়ী, চারটি প্রতিষ্ঠানের কাছে গ্রাহক ও সরবরাহকারীদের ৩ হাজার ১২১ কোটি টাকা পাওনার তথ্য বেরিয়ে এসেছে। এর মধ্যে ইভ্যালির ৯৫০ কোটি, ই-অরেঞ্জের ১ হাজার ১০০ কোটি, ধামাকার ৮০৩ কোটি এবং এসপিসি ওয়ার্ল্ডের ২৬৮ কোটি টাকা দেনার তথ্য রয়েছে।
২০১৮ সালের ডিসেম্বরে মাত্র ৫০ হাজার টাকা পরিশোধিত মূলধন দিয়ে ব্যবসা শুরু করে ইভ্যালি। বিপুল ছাড়ে তরুণদের পছন্দের বিভিন্ন পণ্য বিক্রির লোভ দেখিয়ে তারা অল্প সময়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নেয়। একই পথে হেঁটেছে ধামাকা, কিউকম, ই-অরেঞ্জ, দালাল প্লাস, আদিয়ান মার্ট, সিরাজগঞ্জ শপ, আলাদিনের প্রদীপ, প্রিয় শপ, নিরাপদ ডটকম, এসপিসি ওয়ার্ল্ডসহ আরও কিছু প্রতিষ্ঠান। ইনভেরিয়েন্ট টেলিকম বাংলাদেশ লিমিটেড ‘ধামাকা’ নামের ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান খুলে ৮০৩ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে বলে দাবি করে মামলা হয়েছে।
ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৯ সালের নভেম্বরে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে গ্রাহক পণ্য পাওয়ার পর টাকা ছাড়ের ব্যবস্থা চালু করার সুপারিশ করা হয়। এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের। দীর্ঘ সময়ক্ষেপণের পর গত জুনে পণ্য ছাড়ের পর টাকা ছাড়ের ব্যবস্থা চালু হয়। গত ৪ জুলাই বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ই-কমার্স ব্যবস্থাপনা ‘সুন্দর ও সুচারুভাবে’ পরিচালনার জন্য নির্দেশিকা জারি করেছে। ইতিমধ্যে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো পণ্য দেওয়ার নাম করে গ্রাহকদের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এটি নির্ভেজাল প্রতারণা।
যেহেতু সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে এরা ব্যবসা করেছে, সেহেতু ক্রেতাসাধারণ তাদের প্রতি আস্থা রেখেছে। তাই ই-কমার্সের নামে প্রতারণা করা হলে তার দায় তারাও এড়াতে পারে না। এর আগে মাল্টিলেভেল ব্যবসার নামে গ্রাহকদের সঙ্গে প্রতারণা হয়েছে। সরকার যথাসময়ে পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়েছে। এখন কেউ দায়িত্ব নিতে চাইছেন না। এমনকি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছেন। যাঁরা ব্যবসার নামে গ্রাহকদের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন, কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন, তাঁদের আইনের আওতায় আনতেই হবে। সেই সঙ্গে যাঁরা তদারকির দায়িত্বে ছিলেন, তাঁদেরও জবাবদিহি নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
কতিপয় প্রতারকের কারণে সম্ভাবনাময় ই-কমার্সের অপমৃত্যু কোনোভাবে কাম্য হতে পারে না। গ্রাহকদের স্বার্থ সুরক্ষায় কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হোক।