ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মাতৃভাষায় বই

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের এক হিসাব বলছে, বাংলা ভাষার বাইরে বাংলাদেশে বর্তমানে জীবন্ত ভাষা আছে ৪০টির মতো। তার মধ্যে ৩৪টিই ক্ষুদ্র জাতিসত্তার ভাষা। এ ভাষাগুলোয় কথা বলে বাংলাদেশের ৫০টির মতো জাতিসত্তার প্রায় ২৮ লাখ লোক। ২০১০ সালের শিক্ষানীতি অনুযায়ী এসব জাতিসত্তার প্রাথমিক শিক্ষা তাদের মাতৃভাষাতেই দিতে হবে। তখন ঠিক হয়, যেসব জাতিগোষ্ঠী সংখ্যায় বেশি এবং যাদের ভাষার লিখিত রূপ আছে, এমন ছয়টি ভাষায় বই ছাপিয়ে কার্যক্রমটা শুরু করা হবে।

সিদ্ধান্ত গ্রহণের সাত বছর পর, ২০১৭ সালে প্রথমবারের মতো ক্ষুদ্র জাতিসত্তার শিক্ষার্থীদের জন্য পাঁচটি ভাষায় [গারো, সাদরি, চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা] প্রাথমিকের তিনটি বই প্রকাশ করে সরকার। রোমান হরফ নেবে নাকি বাংলা, এ সিদ্ধান্ত নিতে না পারায় সাঁওতালি ভাষায় কাজটা করা যায়নি। তারপরও তো বাকি রয়ে গেছে ৩০টির মতো ভাষা। তাদের কী হবে? সংখ্যায় কম, এ অপরাধে সরকারি উদ্যোগে বই তৈরি না হওয়া পর্যন্ত তাঁদের সন্তানেরা কি অন্য ভাষাতেই শিক্ষা লাভ করবে?

শ্রীমঙ্গল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নজরুল ইসলাম মনে হয় অত দিন অপেক্ষা করতে রাজি নন। তাঁর উপজেলায় ক্ষুদ্র জাতিসত্তাগুলোর জন্য নিজেই বই তৈরিতে উদ্যোগী হয়েছেন নজরুল ইসলাম। তাঁরই তত্ত্বাবধানে চা–বাগানের সাদরি, খাসিয়াদের খাসি, গারোদের মান্দি, মণিপুরিদের মৈতৈ ও পাঙন—এ পাঁচ ভাষার বই প্রকাশ করেছে উপজেলা পরিষদ। শ্রীমঙ্গলের সরকারি-বেসরকারি ৮৪টি বিদ্যালয়ের ক্ষুদ্র জাতিসত্তার শিক্ষার্থীদের মধ্যে রোমান হরফে ছাপানো প্রায় চার হাজার বই বিতরণ করা হবে।

সুখের কথা, বই বিতরণের এ কর্মসূচির সূচনা হয়েছে ২১ ফেব্রুয়ারি। এমন একটা কার্যক্রমের জন্য এমন একটা দিনই যথার্থ। কারণ, একটা কথা আমরা ভুলেই যাই। সর্বত্র বাংলা ভাষা নয়, একুশ মানে সর্বত্র মাতৃভাষার প্রচলন। অন্য ভাষীদের মধ্যে বাংলা চাপিয়ে দেওয়াটা একুশের চেতনা নয়। একুশ মানে যার যা মাতৃভাষা, সে তাতেই কথা বলবে, লিখবে, পড়বে। ভাষা আন্দোলনকারীরা উর্দুর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেননি, তাঁরা মাতৃভাষার সপক্ষে আন্দোলন করেছিলেন। স্পিরিটটা ছিল যার মাতৃভাষা উর্দু, সে উর্দুতেই কথা বলুক, বাংলা নয়। এ চেতনা থেকে দেখলে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে নজরুল ইসলামের এ উদ্যোগ অন্য তাৎপর্য লাভ করে। তাঁর এ উদ্যোগ অন্য কর্মকর্তাদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ুক।